প্রকাশঃ ২৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০৬:৩২:৪৮
| আপডেটঃ ২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:৪৫:৫৭
ষ্টাফ রিপোর্টার, রাঙামাটি। গত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর রাঙামাটিতে বিশেষ আইন শৃঙ্খলা সভায় দেয়া বক্তব্যে প্রতিবাদ জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। আজ এক বিবৃতিতে সংগঠনটির পক্ষে বলা হয়, পাহাড়ে যারা চাঁদাবাজি ও রক্তপাত করছে তাদের জন্য ভয়ংকর দিন আসছে বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাতে পাহাড়ের জনগনের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষর উপর ধর পাকর চালালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হতে বাধ্য এবং তার জন্য সরকার কখনোই দায়ভার এড়াতে পারে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর: সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির একতরফা অভিযোগ, উস্কানীমূলক বক্তব্য ও হুমকি, জনমনে সৃষ্টি হয়েছে চরম আতঙ্কগত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ২০১৯ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান কামাল বেশ ঘটা করে দুই দিনের এক সফরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন। এসময় খাগড়াছড়ির রামগড়ে এক সমাবেশে এবং রাঙামাটি শহরে দেশের ও পার্বত্যাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুধী সমাজকে নিয়ে অন্তত দুইটি সভায় যোগদান করেন এবং গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে ‘তিন পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিশেষ সভা’ ও আলোচনা সভার ব্যানারে অনুষ্ঠিত দুইটি সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, সংঘাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং যেকোন মূল্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং পাহাড়ে যারা চাঁদাবাজি ও রক্তপাত করছে তাদের জন্য ভয়ংকর দিন আসছে বলে তিনি হুমকি প্রদান করেন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এসব সভায় সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন (র্যাব) এর মহাপরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও স্বরাষ্ট্র সচিব প্রমুখ কর্তাব্যক্তিরাও একতরফাভাবে সন্ত্রাস, হানাহানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে বক্তব্য প্রদান করেন। মাটির তিন ফুটের গভীরে লুকিয়ে থাকলেও সন্ত্রাসীদের বের করে আনা হবে। দুই কোটি লোক বসবাসকারী ঢাকা শহরে এবং অন্য জেলা থেকে ঢাকা শহরে এক কোটি লোকের প্রতিনিয়ত যাতায়াত সত্ত্বেও যেখানে ঢাকা শহর থেকে সন্ত্রাসীদের অনায়াসে খুঁজে বের করা হয়, সেখানে ১৫/১৬ লক্ষ বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা কোন ব্যাপারই নয় বলে হুমকি প্রদান করা হয়। এধরনের একতরফা অভিযোগ ও হুমকির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমনে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে চলমান ধরপাকড়, তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা, রাত-বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাসী ও জিনিসপত্র তছনছ, নির্বিচারে শারীরিক নির্যাতনের ফলে পার্বত্য জনজীবন আজ যেখানে শ্বাসরুদ্ধকর, সেখানে আবার ‘সামনে ভয়ংকর দিনের’ হুমকি জনমানুষকে চরম আতঙ্কগ্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে।
রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এসব সভা কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রক্রিয়াকে সরাসরি লঙ্ঘন করে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ অনুসারে সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়টি সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আঞ্চলিক পরিষদের এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ অনুসারে আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং পুলিশ (স্থানীয়) বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন একটি কার্যাবলী। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক একতরফাভাবে এসব সভা আয়োজন করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণকে কেবল উক্ত সভাগুলোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মাত্র। সভা আয়োজনের কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর সাথে কোনরূপ আলোচনা করা হয়নি। তাই আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এসব সভা পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আইনকে লঙ্ঘন করেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে এসব সভায় একতরফা, মনগড়া ও ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এধরনের অশান্ত পরিস্থিতির পেছনে যে গভীর প্রেক্ষাপট ও ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র রয়েছে সে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে উস্কানীমূলক ও হুমকিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের অব্যাহত টালবাহানা ও গড়িমসির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন যে অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও যোগসাজশে স্বার্থান্বেষী ও তাবেদার মহলকে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, সংঘাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ চালানো হচ্ছে সে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা, চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা, সর্বোপরি জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের হীনউদ্দেশ্যে সরকার, সরকারি বাহিনী ও শাসক দলের একটি বিশেষ মহল যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই ইউপিডিএফ নামধারী চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন গঠন ও মদদ দান, সংস্কারপন্থী নামধারী নব্য দালাল চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সহায়তা প্রদান, আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) নামধারী বিদেশী সশস্ত্র গ্রুপকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়ন ইত্যাদি একের পর এক ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার, সরকারি বাহিনী ও শাসকদলের বিশেষ মহলের এসব ষড়যন্ত্রের কারণেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, রক্তপাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতির পশ্চাতে কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর এই সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ধামাচাপা দিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় খুন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে এবং পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।
বিবৃতিতে পার্বত্য চুক্তি যদি অনুসরণ করে পার্বত্যাঞ্চলে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে, কয়েকটি দাবি দেয়া হয়, সেগুলো হচ্ছে : ১) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং এলক্ষ্যে আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
২) চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মাধ্যমিক শিক্ষা, পর্যটন, উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যাবলী ও ক্ষমতা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে হবে;
৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে;
৪)‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে;
৫) ভূমি কমিশনের বিধিমালাকে অচিরেই যথাযথভাবে প্রণয়ন করে এবং ভূমি কমিশনে পর্যাপ্ত তহবিল ও জনবল বরাদ্দ এবং রাঙামাটি ও বান্দরবানে কমিশনের শাখা স্থাপন পূর্বক ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত প্রদান করতে হবে;
৬) চুক্তি মোতাবেক ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথভাবে পুনর্বাসন করতে হবে;
৭) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে;
৮) চুক্তি মোতাবেক জনমুখী ও প্রকৃতি-বান্ধব উন্নয়নের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে আঞ্চলিক পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসতে হবে এবং পার্বত্যবাসীকে নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করতে আত্মনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ধারা গড়ে তুলতে হবে;
৯) পার্বত্য চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইন ও বিধি সংশোধন করতে হবে;
১০) অলিখিত চুক্তি মোতাবেক বাঙালীদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন প্রদান করতে হবে।
জেএসএসের দাবি তাদের দেয়া দাবিগুলো বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে।
বিশাল বিবৃতির শেষাংশে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ ২২ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আজ দীর্ঘ ১১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে এ যাবৎ এগিয়ে আসতে কোন দৃশ্যমান ও সদিচ্ছাপূর্ণ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। চুক্তি করে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে না, প্রতারণা করা হবে, জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্নকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, পক্ষান্তরে নিজেদের ব্যর্থতাকে ও প্রতারণামূলক ভূমিকাকে ধামাচাপা দিতে তথাকথিত খুন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে দমন-পীড়নের হুমকি দেয়া হবেÑ এটা কোন গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির নীতিবোধ হতে পারে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্ত—বায়ন করা হলে, সামরিক উপায়ে দমন-পীড়নের পরিবর্তে চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলে, তবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হবে। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হতে বাধ্য এবং তার জন্য সরকার কখনোই দায়ভার এড়াতে পারে না।