প্রকাশঃ ০৭ নভেম্বর, ২০২০ ১০:২৬:৫৫
| আপডেটঃ ০৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:১৩:২৬
নিয়ম অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বর বা নতুন বছরের জানুয়ারী মাসে খাগড়াছড়ি পৌরসভার পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। সে হিশেবে শুরুও হয়েছে ভোটার-প্রার্থী এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝে নানামুখী উৎসুক্য ও চাঞ্চল্য।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র পদটি এখন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ন। প্রথম শ্রেণী (বিশেষ) মর্যাদার এই পৌরসভার শান-সওকত যেমন বেড়েছে তেমনি এটির বার্ষিক আয়ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্য যেকোন পৌরসভার চেয়ে বেশি। সরকারি (স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়) বরাদ্দের নির্ভরতা কাটিয়ে খাগড়াছড়ি পৌরসভা নিজস্ব আয়বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি নতুনধারার প্রকল্পের সূচনা করেছে।
পৌর এলাকার সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে খাগড়াছড়ি পৌরসভার বার্ষিক আয় এখন আট কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। নাগরিক সেবার বিনিময়ে কর প্রদানের একটি ইতিবাচক প্রবণতা গড়ে উঠেছে সামর্থ্যবান থেকে দরিদ্র মানুষদের মধ্যেও। এই অভ্যাস গড়ে উঠার পেছনে খাগড়াছড়ি পৌরসভার দুইবারের নির্বাচিত সম্মানিত মেয়র, পৌর কাউন্সিলরবৃন্দ এবং পৌরসভার সব স্তরের কর্তকর্তা-কর্মচারিরা নি:সন্দেহে সাধুবাদ পেতে পারেন। বিশেষ করে স্বল্প বেতনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দিনরাত শ্রমের অবদানে খাগড়াছড়ি শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা স্বীকার করেন, ‘খাগড়াছড়ি শহর’ দেশের একটি অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহর।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রচলিত প্রবাদ হলো ‘পরন সাদা অইলে মন সাদা নঅয়’। খাগড়াছড়ি শহরের ধনী-গরীব নির্বিশেষে অনেক মানুষের মাঝে সাদা পোশাকের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। আবার নব্য নেতা- নব্য ধনীদেরকে দেখা যায় রঙিন পাঞ্জাবীতে শরীর রাঙাতে। খাগড়াছড়ি শহরটি অনেক পরিচ্ছন্ন হলেও এই শহরের জনপ্রতিনিধিদের-রাজনীতিকদের মন সাদা মনে করার কোনই কারণ নেই। তাই খাগড়াছড়ি পৌরসভার আসন্ন নির্বাচনে আমি ও আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে ‘কেমন মেয়র প্রার্থী চাই’ কিংবা ‘কেমন ব্যক্তিকে মেয়র প্রার্থী হিশেবে দেখতে চাই’; তা এখনি ভাবতে চাই।
বিগত দুটি পৌরসভা নির্বাচনকে খুব কাছ থেকে আমি সক্রিয়ভাবে দেখেছিলাম। ভোটাধিকার প্রয়োগের পাশাপাশি আমি অন্য ভোটারদেরদের ভূমিকাও প্রত্যক্ষ করেছিলাম। বলা চলে বিদ্যমান ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির বিপরীতে দুটি নির্বাচনেই আমার জোরালো অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু কখনো আমি আমার পেশাকে বিকিয়ে দেয়নি। পেশার মর্যাদা-নিরপেক্ষতা-বস্তুনিষ্ঠতা বলতে আমি যতোটুকু বুঝি ততোটুকু রক্ষা করেই নির্বাচনী অবস্থানে ছিলাম।
সত্যি কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো; এ দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলনা। এমনকি এ দুটি নির্বাচনকে আপাত দৃষ্টিতে সুষ্ঠু ও অবাধ হিশেবে পরিগণিত করলেও মনোজাগতিকভাবে আমার কাছে গণতান্ত্রিক মনে হয়নি। কারণ, ২০১১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের একজন প্রবীন নেতাকে (প্রয়াত নুরনবী চৌধুরী) প্রার্থী করা হলেও সে নির্বাচনে শেষতক ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ বিভাজনটিই বড়ো হয়ে উঠেছে। দুই প্রতিদ্বন্ধী মো: রফিকুল আলম এবং ধীমান খীসা’র অতীতের সামাজিক ও প্রাক-রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রার্থীকে গ্রহণ করেনি। পাহাড়ের চিরাচরিত নিয়মে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নিক্তিতেই নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হয়েছে।
চমকপ্রদ নির্বাচন ছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরেও। দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের প্রার্থী সংকট দেখা দেয়। হঠাৎ করেই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী মো: শানে আলমকে নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। অভিযোগ আছে, জেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে তৎকালীন মেয়র মো: রফিকুল আলমকে নৌকার প্রার্থী হবার আহ্বান জানানো হলেও তিনি তা অগ্রাহ্য করেন। রফিকুল আলম এবং শানে আলম দুজনই সম্পর্কে আপন কাকাতো-জেঠাতো ভাই এবং প্রভাবশালী খাদ্য ব্যবসায়ী। তাঁরা দুজনই সক্রিয় রাজনীতির বিপরীতে নেপথ্যের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পারিবারিকভাবে শানে আলম পরিবার বিএনপি এবং রফিকুল আলম পরিবার আওয়ামী ঘরানার বলে আগে থেকেই ভোটারদের মনে একটি প্রাক-ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফলে বিএনপি’র প্রার্থী এড. আব্দুল মালেক মিন্টুর পরিণতিও আগের নির্বাচনের আওয়ামীলীগ প্রার্থী নুরনবী চৌধুরীর দশায় পতিত হয়। দুই পরিবারের দুই ভাইয়ের নির্বাচনী যুদ্ধ একপর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রুপ নেয়। দুই পরিবারের নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ভাষা এতো নোংরা এবং অশ্রাব্য ছিল যে, তাঁদেরকে শালীন মনে হতোনা ভোটারদের। সেই যুদ্ধে বড়োভাই নৌকার প্রার্থী শানে আলমকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো রফিকুল আলম মেয়র নির্বাচিত হন। দলীয় প্রার্থীর বিরোধীতা করেছেন; এমন অভিযোগে জেলা আওয়ামীলীগের সা: সম্পাদকের পদ হারান তাঁর বড়োভাই- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো: জাহেদুল আলম। শুধু তাই নয়, দলীয় পদ হারান মেয়র রফিকের ছোটভাই দিদারুল আলমসহ অনেকে। নির্বাচিত হবার পর তিনি এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেন যে, তিনি স্থানীয় এমপি থেকে শুরু করে অনেক বর্ষীয়াণ রাজনীতিককে নানাভাভাবে অপমান-অপদস্ত করতে শুরু করেন। অসহিষ্ণুতার একপর্যায়ে তিনি প্রথম আলো’র ফটোসাংবাদিক নীরব চৌধুরীকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করলে খাগড়াছড়ির সবস্তরের সাংবাদিক তাঁর (মেয়র) বিরুদ্ধে মাঠে নামতে বাধ্য হন। পৌরসভার সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডে তাঁর (মেয়র) একক কর্তৃত্বপরায়ন মানসিকতার বর্হিপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। ‘জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও মেয়র রফিকের অনুসারী’, এই দুইধারায় বিভক্ত হয়ে টানা তিন বছর খাগড়াছড়ি শহর অস্থির ও অশান্ত ছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে উভয়পক্ষ শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের পথ বেছে নেয়।
কিন্তু আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আর আগের মতো নেই। ক্ষমতার পালাবদলে সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, এখন দ্বিতীয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী পদ-মর্যাদায় শরণার্থী টাস্কফোর্স চেয়ারম্যানও। জেলা আওয়ামীলীগ থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন সাংগঠনিক শাখায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনের সেই ঢেউয়ে মেয়র পরিবারের অবস্থান অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক নাজুক। তবে অর্থ-বিত্তে এই পরিবারকে দুর্বল ভাবার কোনই সুযোগ নেই। জনপ্রিয়তা কমেছে কী বেড়েছে; সেটা এই মুহুর্তে বোঝার কোন উপায়ও নেই। তবে এই নির্বাচনেও গতবারের মতো দল-মত নির্বিশেষে ‘রফিক ঠেকাও’ কর্মসূচিতে অনেকে শামিল হবেন বলা যায়।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় সরকারি দলের বেশকিছু শক্তিমান নেতৃত্ব গড়ে উঠলেও জেলাশহরে সেই চিত্র একেবারেই ভিন্ন। নেতা বেড়েছে, গাড়ি-বাড়ি যেভাবে বেড়েছে; সেভাবে নিবেদিত কর্মী বাড়েনি। কয়েকজন তরুণ নেতা ছাড়া বেশিরভাগ নেতারই দু’চারজনের ছোট ছোট বলয় ছাড়া সাধারণ জনগণের সাথে আদর্শের কোন সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারেননি। ২০১১ সাল এবং ২০১৫ সালের মতোই এবারও প্রার্থী খোঁজার জোর চেষ্টা শুরু হয়েছে আওয়ামীলীগে। দলটির জেলা সভাপতি’র আলোতেই যেনো অন্য নেতাদের চোখের দৃষ্টি মেলে। নিজস্ব চিন্তা আর সৃজনশীলতা নিয়ে রাজনৈতিক পথ অতিক্রমের যোগ্যতা উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাদের কর্মকান্ডে প্রকাশ ঘটলেও জেলাশহরে সেই উদাহরণ মেলা ভার। সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় দান-খয়রাত করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার মানসিকতা থেকে বেরোতে পারেননি অনেকে।
একজন সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হবার জন্য প্রাক-প্রয়োজনীয় কর্মকান্ডে যে কজন তরুণ নেতা সক্রিয় আছেন; পাহাড়ের নানা বাস্তবতায় তাঁরা শেষতক মাঠে নাও থাকতে পারেন। পৌঢ়-প্রবীন নেতাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কাউকেই নির্বাচনমুখী জনসম্পৃক্ত তৎপরতায় দেখা মেলেনি। পরিস্থিতি যেনো এমন, ‘কলা খাবেন উত্তরে তিনি বলেন, ছোলা আছেনি?’ এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থী দেয়া ছাড়া আওয়ামীলীগের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। আবার খাগড়াছড়ির বাস্তবতায় পৌর নির্বাচনের মতো একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি-অংশগ্রহণ এবং আন্তরিকতা খুবই জরুরী। প্রথম শ্রেণী (বিশেষ) মর্যাদার একটি পৌরসভার নেতৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক জনগণের কাছে পৌঁছার একটি বড়ো সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া নেতাদের জন্য লাখ-কোটি টাকার ঠিকাদারী ব্যবসাও..
সবকিছু ছাপিয়ে এবারের নির্বাচনে আগেভাগেই প্রার্থী নির্ধারণ করেছে, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি। কেন্দ্রের সিগন্যাল পেয়ে দলটির জেলা নেতারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় খাগড়াছড়ি পৌরসভার জন্য জেলা যুবদলের সা: সম্পাদক ইব্রাহিম খলিলকে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সাবেক ছাত্রনেতা তরুণ এই রাজনীতিক দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে বিনয়ী ও সহিষ্ণু মানুষ হিশেবে পরিচিত। এর আগে জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির নির্বাচনে সা: সম্পাদক পদে নির্বাচন করে তিনি হারলেও সম্মানজনক ভোট পেয়েছিলেন।
খাগড়াছড়ির আগামী পৌর নির্বাচনে যদি বর্তমান মেয়র রফিকুল আলম এবং সরকারি দলের প্রার্থী আবারও মুখোমুখি হন, সেক্ষেত্রে বিএনপি প্রার্থী খলিল; কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।
প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী এবং নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক।