পাহাড়ে সাংবাদিকতা বিকাশে দায়িত্বশীলতা জরুরি : প্রান্ত রনি
প্রকাশঃ ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ ১১:৩২:৩৭
| আপডেটঃ ২০ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:১০:৪০
ডেটা জার্নালিজম বিষয়ক একটি সেমিনারে আলোচক বলেছিলেন, ‘আমরা প্রায়শই দেখি আমাদের আশ-পাশে যখন বহুসংখ্যক মানুষ কেউ রোগে বা ব্যধিতে আক্রান্ত হন, আমরা তখন ভেবে নিই হয়তো আশপাশে রোগটির বিস্তর ঘটেছে চলেছে। এটি হলো এক ধরণের অনুমান নির্ভরতা। কিন্তু ডেটা সাংবাদিকতা বলে, আপনাকে সব দিকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। প্রাপ্ত তথ্যে যদি দেখা যায় রোগটি কেবল একটি বিশেষ এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছে এবং অন্যান্য এলাকায় এটির তেমন কোনো প্রভাব নেই। তখন দেখা যাবে রোগটির ভয়াবহ সামগ্রিকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। ডেটা জার্নালিজম হলো এক ধরণের গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী সাংবাদিকতা। অনুমান নির্ভর সাংবাদিকতাকে বরাবরই খারিজ করে দেয় ডেটা সাংবাদিকতা।’
বর্তমান সময়ে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভর হয়ে পড়ায় ভুল তথ্য, অপতথ্য, কু-তথ্যের বিস্তার ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক কেন্দ্রিক পোস্ট থেকে তথ্যের উৎস খোঁজা ও দায়িত্বশীলদের তথ্য নিশ্চিত ছাড়াই অনুমান নির্ভর সাংবাদিকতার কারণে গুজব বাড়ছে। এই গুজব কখনো কখনো পরিণত হচ্ছে ‘গজবে’ও। গুজবের কারণে হামলা, মৃত্যু, আতঙ্ক সৃষ্টির ঘটনা অহরহ। ডিজিটাল যুগের বাস্তবায়তায় আমাদের তথ্য প্রাপ্তি বা তথ্য প্রবাহ ঘটনা সহজীকরণ যেমন হয়েছে; ঠিক এর বিপরীতটাও লক্ষ্য করা যায়। তথ্যের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত তিন ধরণের ক্ষতিক্ষারক তথ্য পেয়ে থাকি। সেগুলো ভুল তথ্য, অপ-তথ্য এবং কু-তথ্য। ভুল তথ্য হলো এমন ধরণের তথ্য যা সাধারণত ভুল, ত্রæটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর তথ্য। এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুলক্রমে ছড়িয়ে থাকে। অপ-তথ্য হলো কোনো সত্য ঘটনাকে গোপন করার জন্য কিংবা পাঠককে বিভ্রান্তি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে গুজব ছড়ানো হয়। আর কু-তথ্য হলো একেবারে ক্ষতিক্ষারক তথ্য, এ ধরণের তথ্য বিশেষ ক্ষেত্রে ক্ষতি সাধনের লক্ষ্যেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই তিন ধরণের তথ্য এড়িয়ে সঠিক তথ্য জন্যের সব তথ্যের প্রতি সন্দেহ করা, তথ্যের উৎস খোঁজার জরুরি এবং তথ্যটি কারা ছড়িয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে তাদের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। কারা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের কোনো ক্ষতিকর উদ্দেশ্যও তো থাকতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে কিছু উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক। গত বছরের ২৩ আগস্ট রাতে রাঙামাটি জেলার কাট্টলি বিল এলাকায় পাহাড়ের বিবাদমান দুইটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের ‘দুই পক্ষের গোলাগুলিতে ছয় জন নিহতের’ খবর ছড়িয়ে পড়ে। দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন সংবাদভিত্তিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘ছয় জন নিহত’ হয়েছে বলে দাবি করলেও দায়িত্বশীল কোনো সূত্রই তা নিশ্চিত করেনি। যে রাজনৈতিক দলের ৬ কর্মী মারা যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে সেই দলটিও নিজেদের একজন কর্মী নিহতের বিষয়টি স্বীকার করেছিল। যদিও ঘটনাস্থলে পরদিন দুপুরে গিয়ে কোনো মৃতদেহ খুঁজে না পাওয়া মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেনি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতাদের বক্তব্য, দলীয় স্টেটমেন্ট ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী- কোনো পক্ষের নিশ্চিত তথ্য দেওয়ার আগেই ছয়জন নিহতের খবর প্রচার বরাবরই আমাদের দায়িত্বশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই রকম ঘটনার উদাহরণ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রেও। এগুলো আমরা সাধারণত অপ-তথ্য ও কু-তথ্য হিসেবে অভিহিত করতেই পারি। সংবাদকর্মীদের অপেশাদারিত্ব ও ব্রেকিং প্রতিযোগিতার কারণে গুজব ছড়ায় মেইনস্ট্রিম মিডিয়া হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন মিডিয়া হাউজ। এক্ষেত্রে আমাদের উচিত তথ্য নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনে সবার শেষে হলেও প্রচার করা। ব্রেকিং সাংবাদিকতার ভীড়ে ভুল তথ্যে গুজব ছড়ানো প্রতিনিয়ত।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। সমতলের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা যেমন চ্যালেঞ্জিং তেমন রোমাঞ্চকরও। পাহাড়ের কৃষি, পর্যটন, অর্থনীতি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অসংখ্য বিষয়ে কাজ করার সুযোগ আছে এখানে। রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়াও সাংবাদিকতার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, যেটা পাহাড়ের কাজের জন্য পেশার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ের কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ, বন ও জীববৈচিত্র্যসহ নানা দিক নিয়ে লেখার সুযোগ রয়েছে। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে যেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি হলো আপনাকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। আপনি যদি ঘুমাতে যান তাহলে ঘুমকে প্রাধান্য দিতে হবে। জমিতে কৃষি কাজ করলে কৃষিতে গুরুত্ব দিতে হবে কিংবা অন্য চাকরি-ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। সাংবাদিকতার বেলাতেও একই কথা। আপনি যদি সাংবাদিকতা করতে চান এবং দায়িত্বশীলভাবে আন্তরিকতা নিয়ে করতে হবে। কোনোভাবে করছি কিংবা অন্য সহকর্মী লেখা প্রতিবেদন হুবহু পাঠিয়ে বা প্রচার করলেই পেশাদারিত্ব হয় না। যে কোনো তথ্য জানার পর যখন ক্রসচেক করবেন তখন নতুন তথ্য, ভিন্ন তথ্যচিত্র পেতে পারেন। এটি সংবাদের বৈচিত্র্য ও গ্রহনযোগ্যতাও বাড়াবে। একই লেখা বিভিন্ন সাইটে, কাগজে দাঁড়ি-কমাসহ হুবহু পড়ে পাঠক যেমনি বিরক্ত হন তেমনি আমার অগোচরে জানার আগ্রহ ও প্রশ্ন করাকে ভুলতে শিখছি।
পাহাড়ে পেশার লোকজন দিন দিন বাড়লেও পেশার মানোন্নয়নে উল্লেখজনক হয়ে উঠেনি। বেশির ভাগই চলছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রেস রিলিজ ও ডে ইভেন্ট কেন্দ্রিক সংবাদ বিতরণ। এক পাঠকের সংবাদকর্মীদের নানান প্রত্যাশা থাকে। তারা যে কোনো সংকটে ও সেবা পাওয়ার জন্য সংবাদকর্মীদের কাছে ছুটে আসেন প্রচার-প্রকাশনার জন্য। সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ঘটনার উন্মোচন হয়েছে। নির্যাতিতের পাশে মানুষ দাঁড়িয়েছে। অসুস্থ, দুস্থের পাশে মানুষ দাঁড়িয়েছে এমন ঘটনা বহু। এটি সাংবাদিকতার প্রতি সাধারণের মানুষের এক ধরণের নির্ভরতাও। কিন্তু বর্তমান সময়ে সাংবাদিক প্রশ্ন করার বদলে প্রেস রিলিজ কেন্দ্রিক সংবাদিকতার বাড়-বাড়ন্ত হচ্ছে মফস্বল-পাহাড়েও।
আজ থেকে ১৭ বছর আগে দেশে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাত ধরেই অনলাইন সাংবাদিকতা যুগের শুরু হয়। এখন দেশে অনলাইন মিডিয়ার সংখ্যা অগণিত। জাতীয়, বিভাগ, আঞ্চলিক ও জেলাকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বার উন্মোচন হয়েছে অনলাইন সাংবাদিকতার। পার্বত্য চট্টগ্রামেও হাতেগোনা কয়েকটি ‘দৈনিক পত্রিকার’ সঙ্গে যোগ হয়েছে অনলাইনে পাঠককে ‘তথ্য সেবা’র প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। তথ্য সেবা বলছি এ কারণে যে পাহাড়ের মানুষকে স্থানীয় খুটিনাটি ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই অনলাইন পোর্টালগুলো।
যদিও অনলাইন সাংবাদিকতার এ পর্যায়ে এসেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে সমানভাবে অনলাইনে সংবাদ সেবা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এটির সংকট বহুমুখী; এর দায় কেবল গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরে চাপিয়ে দেয়া কোনোভাবে। তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনলাইন সংবাদমাধ্যম গড়ে ওঠেছে রাঙামাটিতেই। কম করে হলেও দশটির প্রতিষ্ঠা তো হয়েছে। বান্দরবান-খাগড়াছড়িতেও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল গড়ে উঠলেও ধারাবাহিকভাবে তথ্য সেবা প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত কোনো পোর্টাল নেই; যেটি নিয়মিতভাবে অনলাইনে সংবাদ প্রচার যাচ্ছে। এখানে রাঙামাটি ও বান্দরবানের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। বান্দরবানের একটি ও রাঙামাটি বেশকয়েকটি অনলাইন পোর্টাল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। যদিও কিছু পোর্টাল অনিয়মিত ও ডে-ইভেন্ট কেন্দ্রিক সংবাদ প্রচারিত করছে। অনুসন্ধানমূলক, কৃষি, অর্থনীতি, প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে খুবই কম সংখ্যক। এটির সংকটের কারণ বহুমুখী রয়েছে।
পৃষ্ঠপোষকতা, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অর্থাভাব ছাড়াও কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের দায় কোনো অংশে কম নয়। সংবাদকর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধ, মত-পার্থক্য ফুটে ওঠে সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। যেটি অত্যন্ত অপেশাদার আচরণ। এছাড়া স্থানীয় অনলাইন সংবাদ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও বিজ্ঞাপন প্রদানের মতো প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী মানসিকতা না থাকায় জর্জরিতভাবে চলছে এই তথ্য সেবা। দিনশেষে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি, সংবাদকর্মী ধন্যবাদ প্রাপ্য।
২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর আত্মপ্রকাশ করেছিল তিন পার্বত্য জেলা কেন্দ্রিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘সিএইচটি টুডে ডটকম’। প্রতিষ্ঠার পর এক দশকে পেরিয়েছে পোর্টালটি। আজ ১১ বছরে পদার্পণ করেছে। দীর্ঘ এই অমসৃণ পথচলায় নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে ও চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। বর্তমানে ‘সিএইচটি টুডে ডটকম’র ফেসবুক পেজের পাঠক সংখ্যা লক্ষাধিক। ভিডিও কনটেন্ট প্রকাশ ও অনলাইনে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই রাঙামাটিতে নিয়মিত অনলাইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে ইভেন্ট কেন্দ্রিক সাংবাদিকতার বাহিরেও বিশেষ কনটেন্ট প্রকাশে আরও জোর দেওয়া জরুরি। সব ধরণের, সব মানসিকতার, বহুমাত্রিক পাঠকদের সংবাদ সেবা প্রদানে একজন পাঠক হিসেবে সিএইচটি টুডের অগ্রযাত্রা সাফল্যের চূড়ান্ত শেখরে পৌঁছুক এটি আমার প্রত্যাশা। আমাদের লক্ষ্য হোক প্রকাশিত সংবাদ পড়ে সাধারণ পাঠক যেন কষ্ট না পান।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী