অপরাধের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকীকরণ কার স্বার্থে? প্রদীপ চৌধুরী
প্রকাশঃ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১০:০৪:০০
| আপডেটঃ ০৪ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:১৩:২০
চলতি সপ্তাহটি পাহাড়-সমতলে অপরাধের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে বলেই মনে হয়। অন্তত: মূলধারার গণমাধ্যমে চোখ বুলালে সেটিরই প্রমাণ মেলে। এক সপ্তাহে এতো বীভৎস ও অমানবিক নারী নিপীড়নের ধারাবাহিক ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে জাতি দেখেনি। প্রতিটি ঘটনাই এতো বেশি হৃদয়বিদারক যে, মনে হতে পারে ধর্ষক-নিপীড়করা একই রক্তের বশংবদ। এরইমধ্যে সরকারি উদ্যোগে প্রশাসনিক তৎপরতায় খুব দ্রুততার সাথে অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করার কাজ শেষ পর্যায়ে। দেশের প্রচলিত আইনে বদমাশদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখার প্রত্যাশায় সারাদেশের বিবেকবান মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্র-যুব সংগঠন রাজপথে হাজির হয়েছেন।
একই সাথে খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে, পাহাড়-সমতলে সমানভাবে সংঘটিত অপরাধগুলোকে কোন কোন পক্ষ বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকীকরণ করে চলেছেন। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো একটু রয়েসয়ে এসব রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্যকে উপস্থাপন করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণহারে তা উস্কানিমূলক ও অস্বস্তিকরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
অস্বীকার করার কোনই কারণ নেই যে, আমাদের দেশে কখনো কখনো রাজনীতি ও ধর্মীয় উন্মাদনার সুযোগে দুর্বলের প্রতি এক ধরনের অবিচার সবসময় সংঘটিত হয়ে আসছে। নানা প্রকার ভয়ভীতি-প্রভাব বিস্তার-সাক্ষী প্রমাণের অভাবে অনেক অপরাধের বিচার হিমঘরে চলে যাবার নজিরও অনুসন্ধানে মেলবে। এমন অভিযোগ দেশের স্বাধীনতার পর থেকে এখনো অব্যাহত আছে। এটা আমাদের দেশের সরকার ও শাসন ব্যবস্থার দীর্ঘ সময়ের চলমান একটি সীমাবদ্ধতা। দেশের কোথাও কোথাও এখনো এমন সমাজব্যবস্থা পাওয়া যাবে; যেখানে লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রকাশের মতো পরিবেশ পর্যন্ত নেই। ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দেয়া, টাকার পরিমাণে অপরাধকে ধামাচাপা অথবা কথিত সমঝোতার গল্প উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমেও।
কিন্তু অপরাধের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকীকরণ কখনো কোন অপরাধের বিচারকে ত্বরান্বিত করেছে; এমন উদাহরণ দেয়াটা কষ্টকর। আর তা যদি উদ্দেশ্যমূলক হয়ে থাকে তাহলে তার পরিণাম ভিকটিম এবং সৎ ও নির্মোহ প্রতিবাদকারীদের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর হয়ে উঠে।
দেশে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। সবকটি যথাসময়ে যথামাত্রায় সবিস্তারে পাঠকের চোখে ধরা পড়ে না। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারের লোকজন যদি অপরাধের সাথে জড়িত হোন তাহলেও বিচার নিয়ে এক ধরনের সংশয়-শংকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে নব্বই দশক থেকে দেশের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মোটামুটি গণতান্ত্রিক একটি অবস্থা বিরাজ করায় মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ যেমন উচ্চকিত হয়েছে; তেমনি গণমাধ্যমগুলোও যেকোন অপরাধের সামর্থ্য অনুযায়ী অনুসন্ধানী ভূমিকা পালন করতে পারছে। ফলে ভয়াবহ কোন অপরাধ এখন আর চাপিয়ে রাখার পথ অনেকটাই সংকুচিত। একটি অপরাধপ্রবণ সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ওপর যতো ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়, তাঁর অনেকটাই সমাজের নীতি-নির্ধারকদের চোখে গৌণ অপরাধ হিশেবেই বিবেচিত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে চলতি পথে সব ধর্মের নারী ও মেয়ে শিশুদের অবস্থা ও অবস্থান প্রায় সমান। এসব বিষয়ে কথা বলা দুরুহ বলেই দেশে নারীর উন্নয়নে যেকোন রাজনৈতিক ও সরকারি উদ্যোগ মাঝপথে চোঁচট খেয়ে পড়ে।
প্রায় একযুগের বেশি সময় ধরে দেশে একটি নারীবান্ধব রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরাজ করছে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে নারীর অগ্রগতির জন্য অনন্য এক বিশ্বজনীন নেতা হিশেবে সমাদৃত। এই সময়কালে দেশের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পদ থেকে সচিব, সংসদ সদস্য থেকে মন্ত্রীসভাসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার প্রতিটি স্তরে নারী সমাজের যোগ্যতার যে বর্হিপ্রকাশ; সেটি জাতি আগে কখনো দেখেনি।
আবার এটাও সত্য যে, আমাদের দেশের বাস্তবতায় সারাদেশে সমসংখ্যক ইউএনও, জেলা প্রশাসক, এসপি, এমপি, মন্ত্রী নিযুক্ত থাকলেও রাতারাতি নারীর প্রতি বৈষম্য-নিপীড়ন কমে আসবে সেটি আমি মনে করি না। কারণ, আমাদের দেশের মূলধারার প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক দল নারীর শক্তিমত্তাকে পুরুষের সমান ভাবতে একেবারে অনভ্যস্ত। আমি পেশাগত জীবনে প্রতিনিয়ত উপলদ্ধি করি, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যদি নারী হন; তাঁর প্রতি সংশ্লিষ্ট পুরুষদের একটু অনমনীয় ভাব অনুভব করেন। জেলা প্রশাসক বা সম-মর্যাদার কর্মকর্তা যদি নারী হোন, তাও একই পরিস্থিতি লক্ষনীয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত দুটি জঘন্যতম ঘটনার উদাহরণ টানছি। সিলেট এমসি কলেজে গৃহবধুকে দলগত ধর্ষণের ঘটনাটির সাথে কারা জড়িত, এটি দিনের মতো পরিষ্কার। সরকারি দলের অনুগত এই ছাত্র সংগঠনটি নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত অনেক ভয়াবহ অপরাধের কথা বহুল প্রচারিত। আবার এসব অপরাধে দন্ডিত হয়ে অনেকে সাজা ভোগ করছেন। কেউ কেউ সাজার মুখে অথবা বিচারের মুখে আছেন। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে সরকারের সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলো অতীতেও এ ধরনের অপরাধ করেছে। কিন্তু বিচারের মুখোমুখি হওয়ার উদাহরণ একেবারেই কম। কিন্তু এই সরকারের সময়ে অপরাধ করে দলের অনেক শক্তিমান নেতাও পার পারছেন না। এটি একটি ইতিবাচক উদাহরণ।
বিপরীত পক্ষের একটি ছাত্র সংগঠন সিলেটের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলছেন পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত গালগল্প। সমতলের মতো একই চিত্র পাহাড়েও।
সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বেশকটি লোহমর্ষক নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় কারা জড়িত তা ইতিমধ্যেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তুলে ধরেছে। কিন্তু একটি পক্ষ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই অপরাধকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করে চলেছেন। অথচ অতীতে এই ধরনের ঘটনার বিচারের আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকী ও রাজনৈতিকীকরণের ফলে প্রকৃত দোষীরা আড়াল হবার সুযোগ পেয়েছেন। পাল্টাপাল্টি আন্দোলন আর বাদ-বিবাদের ব্যত্যয়ে অনেক নির্মোহ প্রতিবাদ চুপসে গেছে সাম্প্রদায়িকতার তোড়ে।
অপরাধ এবং অপরাধীর গায়ের বর্ণকে চিহ্নিত করে অপরাধের বিচার এবং অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করার এই মানসিকতা কোনভাবে ন্যায়সাপেক্ষ হতে পারেনা। পুরনো অপরাধের অনেক ছবি সামনে এনে সাম্প্রতিক ঘটনার ভয়াবহতা তুলে ধরছেন কেউ কেউ। কিন্তু সেসব অপরাধের বিচার নিশ্চিত হয়েছে কীনা বা সেব ঘটনার বিচারিক কাজে অথবা ওইসব ভিকটিমের পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়িয়েছেন কীনা; সে প্রশ্নটিও উঠতে পারে।
‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ উত্তর পাহাড়ের পরিবেশ প্রত্যাশা মাফিক এগিয়ে যায়নি। এটির দায়দায়িত্ব রাজনীতি ও রাজনীতিকদের। কিন্তু যেকোন অপরাধের বিচার চাইতে গিয়ে উপুর্যপরি একটি জনগোষ্ঠিকে উদগ্রভাবে দোষারোপ মূলত অপরাধকে এবং অপরাধীদের ‘কালার ব্র্যান্ড’-ই করা হয়।
তারপরও দেশে নীরবে একটি নারী-পুরুষের ভারসাম্যপূর্ন অগ্রগতি ঘটে চলেছে। দৈশিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতা, নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, সর্বোপরি বর্তমান সরকারের প্রত্যক্ষ প্রণোদনায় নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রগতি প্রতিদিন প্রতিমুর্হুতে দেশ-সমাজের অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে।
পাল্টে যেতে বাধ্য হচ্ছে আমাদের দর্শন দোদুল্যমান প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গীও।
তাই আসুন, নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার চোখে না দেখে প্রতিবাদের ভাষাকে সার্বজনীন অবয়বে দেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। একটি অপরাধবিহীন দেশ-সমাজ তাবৎ পৃথিবীতে এখনও সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই অপরাধের বিরুদ্ধে সম্মিইলতভাবে উচ্চকণ্ঠ থাকার কোনই বিকল্প নেই। পাহাড় এবং সমতলে সংঘটিত সব অপরাধকে ‘সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু’ বিবেচনায় না নিয়ে সবলের ওপর দুর্বলের অত্যাচার-অবিচার হিশেবেও আমরা দেখতে পারি। সাহস ও সংঘবদ্ধ অসাম্প্রদায়িক গ্রহণযোগ্য সার্বজনীন আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের সব বিবেকবান মানুষের ঐক্য গড়ে উঠতে পারে।
আর এ ধরনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াতেই দেশে একাত্তরের স্বপ্নাদ্য ‘অসাম্প্রদায়িক’ বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের চেতনা সঞ্চারিত হবে।
প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী ও নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক।