প্রকাশঃ ২৫ অগাস্ট, ২০১৯ ০৯:৪৭:০৩
| আপডেটঃ ২০ নভেম্বর, ২০২৪ ০৯:১৪:৩২
সারাদেশ যখন একজন জেলা প্রশাসকের স্ক্যান্ডাল নিয়ে ব্যস্ত ঠিক একই সময়ে একজন মাননীয় সংসদ সদস্যও দিনভর এই অনলাইন-সে অনলাইন-এ শিরোনাম হয়েছেন। অবশ্য, জামালপুরের জেলা প্রশাসকের কীর্তিকান্ড আর সংসদ সদস্যের কর্মকান্ড; একই পাল্লায় মাপার মতো নয়। তবুও ‘অফলাইন’ আর ‘অনলাইন’-এ দুই জনই সমান গুরুত্ব পেয়েছেন।
ঘুরতে ঘুরতে-পড়তে পড়তে মাথা কিছুটা ভারীই হয়ে গিয়েছিল। তবুও ধৈর্য্য ধরে ছিলাম। এর মূলে আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সংসদ সদস্য ‘রুমিন ফারহানা।
১২ আগস্ট ‘বাংলা ট্রিবিউন’-এ ‘আপা, আপনি নিউ মার্কেটেও আসেন!’ এই শিরোনামে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বৈষয়িক ভোগ-বিলাসের একটি চিত্র তুলে ধরেছিলেন।
আমি খুব আহ্লাদের সাথে সেটি ব্যক্তিগত ফেইসবুক একাউন্ট থেকে শেয়ার করেছিলাম। ঠিক তার তেরো দিন মানে দুই সপ্তাহের মাথায় তিনিও ভার্চুয়াল জগতে ভাইরাল হয়ে উঠলেন।
আমাদের দেশে এযাবত কালের সবকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন-ই সাংবিধানিক বৈধতা পেয়ে আসছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও তার একটি। সেই নির্বাচনে ভোটবিহীন পরিবেশে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও সংবিধান স্বীকৃত ‘মাননীয় সংসদ সদস্য’ হিসেবে সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা বহাল তবিয়তে ভোগ করেছেন। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিতরাও তাই করেছিলেন। রুমিন ফারহানাও একই ধারাবাহিকতায় একজন সংসদ সদস্য হিসেবে সরকারি প্লট বরাদ্দ চেয়েছেন। যদিও, তিনি এখনও সরকারি শুল্কমুক্ত গাড়ি চাননি।
উচ্চ আদালতের একজন বিজ্ঞ আইনজীবি হিসেবে এবং মিডিয়ায় উচ্চকন্ঠ একজন তরুণ রাজনীতিক হিসেবে রুমিন ফারহানার একটি স্বতন্ত্র অবস্থান সব মহলেই স্বীকার্য্য। কিন্তু তিনি যদি কোন ভুল করেন বা ন্যায়ের পথ লঙ্ঘন করেন, তাহলে তো মিডিয়া উচ্চকন্ঠ হবে অনির্বার্য্যভাবেই।
সেটিই ঘটেছে সম্ভবত। দেশের নেতৃস্থানীয় থেকে শুরু করে চুনোপুটি মিডিয়াও তাঁকে নিয়ে বেশ বাজিমাত করেছে। বেশিরভাগ খবরে তাঁকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে খুব জোরের সাথে। কারণ, তিনিই একাদশ জাতীয় সংসদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বর্তমান একাদশ সংসদকে অবৈধ এবং খোদ সরকারকেও বেআইনী বলতে দ্বিধা করেন নি। অথচ, সেই সংসদেই তিনি প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং ফ্লোর নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এবং তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সপক্ষে কথাও বলছেন!
সেই সংসদে সরকার এবং তাঁর নিজের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য করার সুযোগ পেয়েও আবার বলছেন, ‘আমরা কিছুই পাচ্ছি না’। ব্যক্তিগত জীবনে এমপি রুমিন ফারহানা, একজন সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা প্রয়াত অলি আহাদ একজন লড়াকু ভাষা সৈনিক ও ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ (এনডিএল)’-এর প্রধান ছিলেন। অবিভক্ত পাকিস্তানে তিনি একজন অগ্রগন্য রাজনীতিক ছিলেন। তাঁর মাতাও বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে প্রথম দিককার একজন উচ্চ শিক্ষিত জাতীয় মানের গুরুত্বপূর্ন সরকারি কর্মকর্তা। একজন সাহসী রাজনীতিক ও তরুণতম সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
তিনি একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্র ও সংবিধান নির্ধারিত অধিকারের জন্য আবেদন করতেই পারেন। মাতৃ ও পৈতৃক সহায়-সম্পদ থাকা কোন অপরাধ নয়। দেশের প্রথম থেকে এযাবতকালের সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হলফনামা তলিয়ে দেখলে এমনও নজির পাওয়া যাবে, যেখানে সম্পদ গোপন করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন; এমন অনেক নজির মিলবে।
কিন্তু, ব্যক্তিগত হলফনামায় তা গোপন করা অপরাধ। পত্র-পত্রিকার খবরে মনে হয়েছে, ‘রুমিন ফারহানা’ কিছু একটা গোপন করতে চেয়েছেন। আর তা করতে গিয়েই তিনি, আমাদের মতো সহজ-সরল গণতন্ত্রপ্রেমী অনেক মানুষের মনে কষ্ট উদ্রেক করেছেন।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ, আমাদের কাছে রুমিন ফারহানাদের মতো মানুষ সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক ও আদর্শিক আইডল হবার কথা। যেই মাসে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট, সতের আগস্ট এবং একুশে আগস্টের বেদনা এবং তা নিয়েই আমরা উদ্বিগ্ন। এমন মাসে তো রুমিন ফারহানা’র মতো মানুষরা কোন কথা বলছেন না। অহেতুক নিজের সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ব্যস্ত; সেই মাসে তাঁকে নিয়ে অহেতুক ভাবনা, সত্যিই আমাদের কাছে, দারুণ এক প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়।
ধরেই নিলাম, তিনি হয়তো মহাভুল করেছেন। কিন্তু, সব মিডিয়া-ই যখন দেখি, শুধু ‘সরকার প্লট দিলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন রুমিন’ এমন শিরোনাম দেখি; তখন সত্যিই আহাম্মক হয়ে যাই। তিনিই কী শুধু, প্রথম এই অপরাধ করেছেন? সংবাদপত্রে যদি দেখতাম... দেশে এমন অনেক সন্মানিত জনপ্রতিনিধি-মন্ত্রী-সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা রুমিন ফারহানা বা তাঁদের মতো পারিবারিক তথ্য গোপন করে অপরিমেয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন!
একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদের দেশে সরকারিভাবে বহুলাংশে সরকারি শুল্কমুক্ত গাড়ি এবং প্লট-ফ্ল্যাট পাওয়া তো আসলেই মামুলি। কেউ নেননি বা নিতে চাননি, এমন উদাহরণ সত্যিই দুষ্কর। ‘রুমিন ফারহানা’ না হয়, খুব তাড়াতাড়িই সরকারি সুযোগের জন্য আবেদনপ্রার্থী হয়েছেন। হয়তো তাঁর খুব তাড়া ছিল। একই সময়ে বা অন্য সংসদ সদস্যরা কি আবেদন ছাড়াই সুযোগ-সুবিধা পাবেন? তাও তা তো প্রশ্ন সাপেক্ষ।
তবু বলতে ইচ্ছে করে, একজন ‘রুমিন ফারহানা’র অবেদনের পর পত্র-পত্রিকা অন্তত: গা ঝাড়া দিতে পারে, সেটিও কম কী?
প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী