প্রকাশঃ ১২ মে, ২০১৮ ১১:৪৯:৩৫
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:২৭:০৭
বিশেষ প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি। পর্যটন বিকাশের বদৌলতে সাজেক’র পরিচিতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লেও সেই পাহাড়ি জনপদের শিক্ষার অবস্থা একেবারেই নাজুক। সরকার কয়েক বছর আগে বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন কর্মসূচির আওতায় বেশ কয়েকটি নতুন বিদ্যালয় চালু হলেও ভৌগলিক কারণে বাদ পড়েছে অনেক এলাকাই। ফলে অনেক বসতি এলাকার শিশুরা রয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণের বাইরে। আবার কোন কোন এলাকায় বিদ্যালয় থাকলেও পাহাড়ি পথে পায়ে হেঁটে শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে সাহস পান না মা-বাবারা। এমনিই ২৩ জন শিশু’র জন্য সাজেক’র সুউচ্চ রুইলুই (লুসাই) পাহাড়ের নিচে ঝরনা পাড়া এলাকায় কলেজপড়–য়া সুনম চাকমা চালু করেছেন ব্যতিক্রমি এক বিদ্যালয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঝরনা পাড়ায় পিচঢালা সড়কের দুই পাশে এবং কিছুটা উপরে-নিচে ১১টি চাকমা পরিবারের বসবাস। কেউ জুমচাষী, কেউ বনজীবি আবার কয়েকজন ক্ষুদে দোকানী। নিজের সহায়-সম্বল বলতে তেমন কিছুই নেই। কিন্তু সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের রয়েছে অদম্য আগ্রহ। সেই আগ্রহে আলোর শিখা হয়ে ধরা দিয়েছেন, দরিদ্র পরিবারের কলেজ ছাত্র সুনম চাকমা।
গত বুধবার সকালে গিয়ে দেখা গেলো, সাজেক যাবার মূল সড়কের পাশে চওড়া মতো একটি জায়গায় বেড়া দিয়ে বানানো একটি ঘরের সামনে সটান বাঁশের মাথায় পতপত করে উড়ছে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। বেড়ার তরজা কেটে খিড়কি (জানালা)-র মতো খোপ দিয়ে উঁকি মারছে অনেকগুলো শিশুর মুখ।
কৌতুহল নিয়েই সামনে যেতেই দেখা গেলো দরজার পাশে ঝুলছে একটি পিতলের ঘন্টিও। ছোট কক্ষটির ভেতরে তিনপাশে বসে আছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া ২৩ জন ছেলে-মেয়ে। প্রত্যেকের গায়ে স্বল্প দামের পোশাক-আশাক হলেও চোখেমুখে বুদ্ধিদীপ্ত অবয়ব। সামনে সরকারি বিনামূল্যের রঙিন রঙিন বই।
জানতে চাইলাম এই বিদ্যালয়ের নাম কি, সাইনবোর্ড নেই কেন? প্রশ্ন শেষ না হতেই দীঘিনালা ডিগ্রী কলেজে অধ্যয়নরত সুনম চাকমা শোনালেন অন্যগল্প। সুনম বলে চললেন, এটি সরকারি বা বেসরকারি কোনই বিদ্যালয় নয়। এখানকার ২৩টি ছেলে মেয়েই ‘ডাবআদাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর ছাত্র-ছাত্রী। যেটি ঝরনাপাড়া থেকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরে। আর সেই বিদ্যালয়ে যেতে হলে কিছুটা মূল সড়ক দিয়ে যেতে হয়। যেপথে দূর্ঘটনার ঝুঁকি। আবার কিছুটা পাহাড়ি উঁচু-নিচু বন্ধুর পথে বন্য পোকামাকড়েঁর ভয়। সব মিলিয়ে এসব শিশুরা বিদ্যালয়ের পরীক্ষা, জাতীয় দিবসের কর্মসূচি ছাড়া অন্য সময়ে নিয়মিত সুনমের স্কুলেই পাঠগ্রহণ করে থাকে।
সুনম চাকমা বললেন, সাজেক ঝরনাপাড়া থেকে তার বাড়ি ২০ কিলোমিটার দূরের গঙ্গারাম এলাকায়। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। ২০১৬ সালে বাঘাইহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করার পর ভর্তি হন খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ডিগ্রী কলেজে। কিন্তু জুমজীবি মা-বাবার পক্ষে কলেজে যাবার প্রতিদিনকার গাড়ি ভাড়াও দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কলেজে খুব বেশি ক্লাস করা সম্ভব না হলেও লেখাপড়ায় হাল ছাড়তে নারাজ। তাই নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই টিউশনি খুঁজতে খুঁজতে সাজেকে আসা। দুই বছর আগে এখানে এসে দেখেন এখানকার বাচ্চারা বছরে ছয় মাসেও বিদ্যালয়ে যায় না। কিন্তু প্রতিটি অভিভাবকই চান, তাঁদের সন্তানদের প্রাথমিক পাঠটি শেষ করে সন্তানদের বাইরের বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সুনম সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে একটি বাড়িতে লজিং নিবেন। কিন্তু তাতে খুব বেশি ফল দেবে না, বুঝেই অভিভাবকদের নিয়ে বসলেন একদিন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর চেয়ে পরিবারের প্রতিটি শিশু নির্ধারিত একটি স্থানে জড়ো করে নিয়মিত পাঠ দেয়া এবং নেয়ার কাজ করলে শিশুদের শিক্ষা জীবনে কোন ছেদ পড়বে না।
স্থানীয় ক্ষুদে দোকানী জগদীশ চাকমা। তাঁর তিন মেয়ে সাধনা-নয়না এবং কল্পনা সুনম চাকমা’র বিদ্যালয়ে পড়ে। সেই ঘরেই সুনম চাকমা’র থাকা-খাওয়া হয়।
জগদীশ চাকমা বললেন, শিক্ষক সুনম চাকমা খাওয়া-দাওয়া আমার ঘরে হলেও এসব রসদের যোগান আসে তিনিসহ ১১ পরিবারের কাছ থেকেই। আমরা প্রত্যেক পরিবার সুনমের বার্ষিক খোরাকি বাবত সোয়া ২৭ কেজি করে চাল প্রদান করি। তবে চাল সমানভাবে দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তরি-তরকারিও যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী দেয়া হয়। বাড়তি চাল বিক্রি করেই শিক্ষক সুনমের লেখাপড়া-পোশাক পরিচ্ছদসহ অন্যান্য খরচ তিনি তাঁর মতো চালান। বিদ্যালয় ঘরটি পাড়ার সবাই স্বেচ্ছাশ্রমে বানিয়েছি।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লুম্বিনী চাকমা’র কাছে জানতে চেয়েছিলাম নিজের স্কুল ছেড়ে এখানে পড়তে কেমন লাগে? প্রতিক্রিয়ায় সে বললো, মা-বাবা দুজনই জুম করে। অন্যসময় বনে কাঠ-লাকড়ি আর বাঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করে। বাসায় থাকার কেউ নেই। তাই সুনম স্যারের কাছে পড়তে পেরে ভালো লাগে। স্যার না থাকলে তো পড়তেই পারতাম না।
শিশু শ্রেণির কালাবি চাকমা শুদ্ধ উচ্চারণে একটি বাংলা ছড়া পাঠ করছিলো। সে বললো একদিন বড় হয়ে শিল্পী হতে চায়, সে।
বিপুল চাকমা গত বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় ‘ডাবআদাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ থেকে সেরা তিনে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে বললো সুনম স্যারের কাছে পড়তে অনেক ভালো লাগে। আগামী বার্ষিক পরীক্ষায় সে প্রথম হবার গল্প শোনালো।
অভিভাবক ইন্দু কুমার চাকমা বলেন, সাজেকের সৌন্দর্য্য দেখতে কতো লোকজন আসেন। সরকারি-বেসরকারি অনেক অনেক ধনীরা আসেন। তাঁদের গাড়ির চাপে আমাদের শিশুরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারে না। সে যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের খরচে স্কুল চালু করতে বাধ্য হয়েছি। অথচ কেউ কোনদিন উঁকি দিয়ে দেখেনি আমাদের এই দুরাবস্থা।
আরেক অভিভাবক রজনী চাকমা বলেন, আমার সন্তান সুনমের কাছে পড়লেও আমি নিয়মিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথেও যোগাযোগ রাখি। দূরের স্কুলে পড়লে বাচ্চারা নিয়মিত খেতে পায় না। আর বাড়ির কাছের নিজেদের বানানো স্কুলে পড়লে খাবারের কোনই সমস্যা হয় না।
সুনম চাকমা বলেন, গত দুই বছরে যেসব শিশু ‘ডাবআদাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে, তারা ভালো ফলাফল করছে। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পাঠ দেয়া নেয়ার কাজ করি। প্রায় প্রতিদিনই ১১টি বাসায় আসা-যাওয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের খোঁজখবর রাখি। টাকার অংকে কাজটিকে বিবেচনা করছি না। অনেকটা নিজের জীবন আর এসব শিশুদের জীবন পাল্টানোর চিন্তাটাই মাথায় কাজ করে বেশি।
সুনম অকপটে স্বীকার করেন, সব শিশুরা চাকমা ভাষাভাষি হওয়ায় বইয়ের পড়াগুলো বাংলা এবং চাকমা, এই দুই ভাষাতেই বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে বাচ্চারাও খুব মজা পায়।
তিন পার্বত্য জেলায় প্রান্তিক শিশুদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে, ‘জাবারাং কল্যাণ সমিতি’। সেই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, দেশের নদী ও হাওড় অঞ্চলের চেয়েও পার্বত্য তিন জেলার ভৌগলিক গঠন দুর্গম। এখানকার মানুষের বসতি, জীবন-জীবিকাও ভিন্নতরো। সমতলে যেখানে পাড়াপ্রতি কয়েক’শ পরিবার নিয়ে একটি গ্রাম গঠিত হয়, সেখানে পাহাড়ে তিন-চারটা পাড়া মিলিয়েও এক’শ পরিবার হয় না। তাছাড়া পানীয় জল, সমতল জায়গার সংকটে একেকটি পরিবার থেকে একেকটি পরিবারও থাকে অনেক দূরে দূরে। এসব বাস্তবতাকে মাথায় নিয়ে প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে সুনম চাকমা’র অনুকরণে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে উঠতে পারে।
খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সুমেধ চাকমা। তিনি বছর দুয়েক ধরে সাজেকে রিসোর্ট থাকার সুবাদে প্রতি সপ্তাহেই আসা-যাওয়া করেন।
তিনি বলেন, সুনম চাকমা’র উদ্ভাবনী চিন্তা থেকে সূচিত এই ধরণের বিশেষায়িত অস্থায়ী শিশু শিক্ষা কেন্দ্র তিন পার্বত্য জেলার বাস্তবতায় খুবা জরুরী। এটিকে মডেল হিসেবে নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ আরো সহায়ক কিছু পদক্ষেপ নিলে পাহাড়ের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় ঝড়ে পড়ার হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
সাজেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা বলেন, সাজেক এলাকাটির অবস্থা এবং অবস্থান দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেই জানা। এখানকার মানুষের জীবন সংগ্রামও জানা। তাই পর্যটন বিকাশের সাথে সাথে এই এলাকার দরিদ্র-বঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সুনম চাকমা’র মতো তরুণদের উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা কামনা করেন।
বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান সুমিতা চাকমা জানান, এ ধরনের শিশু শিক্ষা কেন্দ্র সরকারিভাবে অনুমোদন না থাকলেও সাজেক এলাকার জন্য খুবই ফলপ্রসূ। বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কমিটির মাসিক সভায় আলোচনা করে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হবে।