কোন পথে হাটছে পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম ?
প্রকাশঃ ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ০৮:৫৪:২৩
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০২:১৩:৩৫
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসে ২০১৭ সাল থেকে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ২০১৭ সালে প্রথম বছর প্রাক-প্রাথমিকে মাতৃভাষার বই বিতরণ শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাহাড়ি শিশুদের দেওয়া হয় মাতৃভাষার বই। সারাদেশে পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে মাতৃভাষায় বই বিতরণ করা গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে কেবল চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরাই এই শিক্ষাক্রমের আওতায় এসেছে। তবে অন্য ভাষাভাষি শিশুদের মাতৃভাষার শিক্ষা নিয়ে এখনও কোনো সুখবর নেই।
এদিকে, রাঙামাটি জেলায় ২০১৭ সাল থেকেই চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরা মাতৃভাষার বই পেয়ে আসলেও আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে তারা নিজেরাই মাতৃভাষায় পাঠদানে নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তুলছে পারছেন না। মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য বিষয়ভিত্তিক আলাদা শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজনও মনে করছেন তারা। যুগোপযোগী পরিবেশের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম। পাহাড়ের শিক্ষাবিদরা মনে করেন, কেবল নামমাত্র উদ্যোগ নিলেই হবে না। মাতৃভাষায় শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাতৃভাষায় পাঠদান করা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, রাঙামাটি জেলা চাকমা জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানে চাকমা শিশুরাই বেশি। তবে ২০১৭ সাল থেকে মাতৃভাষায় পাঠদান শুরু হলেও আশানুরুপ অগ্রগতি নেই। শিক্ষার্থীরা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জাতির নিজস্ব বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হলে পারলেও বাক্য গঠন করতে পারছেন না বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। অনেক শিক্ষক নিজেরাই ভালোভাবে পারছেন না পড়াতে। শহুরে এলাকা থেকে প্রান্তিক এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এই দশা আরও বেশি!
রাঙামাটি সদর উপজেলা দক্ষিণ কুতুকছড়ি আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডেবিট চাকমা বলেন, ‘আবাসিক বিদ্যালয় হওয়ায় আমাদের বিদ্যালয়ে অন্য ভাষাভাষি শিক্ষার্থীও রয়েছে। তবে শিক্ষার্থী থাকলেও তিন মাতৃভাষায় পাঠদান চালু হওয়ায় অন্য ভাষার শিশুরা বই পান না। সাধারণত যেসব শিক্ষক জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেনী কার্যক্রমে পাঠদান করেন; তাকেই আবার মাতৃভাষার বই পড়াতে হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রমে জোর দেওয়ার কারণে মাতৃভাষার শিক্ষার ভালোভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়ে ওঠে না।’
তিনি আরও বলেন, মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তাও পর্যাপ্ত নয়। একটি ভাষার ওপর পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষকের তিন-চার দিনের প্রশিক্ষণে কিছুই হয় না। অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা নিজেদেররাই সঠিকভাবে সব শব্দগুলো জানেন না। চিনতে পারেন না। আমি বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও বলেছি, মাতৃভাষার শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের ভালোভাবে নিয়ম নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। প্রয়োজনে পাড়াকেন্দ্রের মতো এলাকাভিত্তিক শিক্ষক রাখা যেতে পারে।’
রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস (ডিপিইও) সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরও রাঙামাটি জেলায় ২৮ হাজার ১৫৫ জন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মাতৃভাষার ৬৩ হাজার ৪৬৮টি বই বিতরণ করা হয়। এরমধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ৭ হাজার ৯ জন, প্রথম শ্রেণীর ৭ হাজার ৪৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৭ হাজার ১০৯ ও তৃতীয় শ্রেণী ৬ হাজার ৯৯৪ জন শিক্ষার্থী মাতৃভাষায় বই পেয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস (ডিপিইও) হৃষীকেশ শীল জানান, ‘সরকার ২০১৭ সাল থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম চালু করেছে সরকার। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত চারটি শ্রেণীতে মাতৃভাষার বই দেওয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থাৎ রাঙামাটি জেলায় চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান করা হচ্ছে। এখানে অন্য ভাষাভাষি শিশুরা থাকলেও তাদের মাতৃভাষায় পাঠদানের বিষয়ে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্তের খবর আমরা পাইনি।’
অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিশুরা নিজ ভাষার অক্ষর চিনতে পারছে। রাঙামাটি জেলার মধ্যে জুরাছড়ি উপজেলাসহ কয়েকটি এলাকায় মাতৃভাষায় পাঠদানে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। আমরা সরেজমিন পরিদর্শন করেও দেখেছি। তবে স্পেসিপিক এলাকায় যদি তুলনামূলক অগ্রগতি দেখা না যায় সেক্ষেত্রে আমরা সেই বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ নজর দেব। শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাতৃভাষার শিক্ষায় পরীক্ষা বা মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকলেও অনেক বিদ্যালয়ই শিক্ষার্থীদের জানার পরিথি যাচাইয়ে ১০ নম্বর ওপর মূল্যায়ন পরীক্ষা নেন।’
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘সরকার ২০১৭ সালে পাহাড়ি ও সমতলের আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পাঠদানের যে উদ্যোগ নিয়েছে; সেটিকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু উদ্যোগের অগ্রগতি খুব একটা আশানুরূপ হয়নি। আমরা বলেছি কোনো উদ্যোগই যেন লোক দেখানো, নামমাত্র না হয়। শিক্ষার্থীরা যেন তার নিজ ভাষাকে চিনতে পারে, লিখতে পারে। যতদূর জেনেছি মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেটি পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষকরাই যদি ভালো না জানেন, বর্ণমালা চিনতে না পারেন; তাহলে তারা কী শেখাবেন।’