কাল থেকে রাঙামাটির সাজেকে আবারো পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে প্রশাসন রাঙামাটির নতুন জেলা প্রশাসক হাবিব উল্লাহ রাঙামাটিতে পৌরপ্রাঙ্গণ মাঠ উন্মুক্ত রাখার দাবিতে মানববন্ধন রাঙামাটির ভেদভেদীতে জমি দখল নিয়ে দুই প্রতিবেশীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এপেক্স ক্লাব অব বান্দরবান এর উদ্যোগে বান্দরবানে বৌদ্ধ অনাথালয়ে কম্বল বিতরণ
৭০ দশক। ৮০ দশক এবং ৯০ দশকে যারা পাহাড়ে সাংবাদিকতা করেছেন তাদের প্রতি সব সময় অঘাত শ্রদ্ধা আমার। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে তাদের ভুমিকা ছিল অপরিসীম। সম্প্রীতি রক্ষায়ও ছিলেন অগ্রণী ভুমিকায়। এখন তারা ভাল বক্তা। কিন্তু লেখনীতে তারা অধিকাংশ নিস্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এর কারণ প্রযুক্তির সাথে তারা তাল মেলাতে পারেনি। ফলে ফিছিয়ে পড়েছেন। প্রযুক্তি এগিয়েছে কিন্তু তারা এগুতে পারেননি। তারা বৈষম্য শিকার হয়েছেন।
ঢাকায় যখন ডিজিটাল প্রেস স্থাপন করা হচ্ছে বা যখন মোবাইল ইন্টারনেট যুগের সূচনা হয়েছে তখন পাহাড় ছিল অন্ধকারে।
নিরাপত্তার অজুহাতে পুরো পাহাড় আধুনিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। বঞ্চিত ছিলেন আমাদের সাংবাদিকরা। সারা দেশের মানুষ যখন মুঠোফোনে হাই- হ্যালো করত তখন পাহাড়ের মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবত। বলত, এটি কি?
শহরের মানুষ যখন মোবাইলে কথা বলার জন্য রিচার্জ করার কথা বলতেন তখন পাহাড়ের মানুষ চিন্তা করত মোবাইলে কিভাবে টাকা প্রবেশ করানো যায়? কল্পনা করত সম্ভবত মোবাইলের পেছনের কাভার খুলে টাকা প্রবেশ করানো হয়!
মোট কথা পাহাড়ের মানুষ দেশের মুল ¯্রােতধারা মানুষদের সাথে পিছিয়ে ছিলেন। তারা দেশের মানুষের সাথে একই সময়ে মোবাইল সেবা পাননি। ইন্টারনেট সংযোগ পাননি। পেয়েছে অনেক পড়ে। এক প্রকার আমাদের জঙ্গলী মানুষ হিসেবে রাখা হয়েছিল। সাংবাদিকরা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পাহাড়ের বাস্তবতার কারণে তারা পারেননি।
এর মাঝে দেশে অনেক মিডিয়া হাউজ গড়ে উঠে। তৈরি হয়েছে অনেক সাংবাদিক। তবে দুর্ভাগ্যর খবর হল সাংবাদিকতার উন্নতি হলেও সাংবাদপত্র উন্নয়ন হয়নি। পুরো মিডিয়া হাউজ হয়ে যায় কর্পোরেট কোম্পানীদের দখলে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে পত্রিকা বাজারে আনে। দুই মাসপর শুরু হয়নানা তাল বাহানা। বিনা পয়সায় মগজ খাওয়া শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় বেতন দেয় না। এভাবে চলতে চলতে মাসের পর মাস বছরের পর বছর জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিরা বেতন ভাতা পায় না।
পাহাড়ের সংবাদ কর্মীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও পায় না। বঞ্চিত হয়। নিজের কষ্ট নীরবে বুকের মধ্য রেখে অন্যর কষ্টের ভাগীদার হয় তারা। তারা বড় মনের মানুষ। নিজের কষ্ট তারা কাউকে দেখায় না।
তবে কয়েকটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ভাল বেতন দেয় এর নজিরও কিন্তু আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের হয়ে যারা পাহাড়ে কাজ করে তারাও পায়।
এখন প্রশ্ন করা যায়, বেতন নেই তো কাজ করে লাভ কি? এ প্রশ্ন আমারও। এই পেশায় কারা আসে? আমার মত অধমরা এই পেশায় কেন?
দেশে অধিকাংশ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান তো বেতন দিতে পারে না। লম্বা লম্বা লেকচার মারে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। ওদের মাথায় ঘুরে চুরি করানোর বুদ্ধি। তারা সাংবাদিকতা শিখাতে পারে না। তবে সাংবাদিক বানাতে পারে! আর এরা সাংবাদিকতা না করে এক ব্যাগ ভিজিটিং কার্ড নিয়ে দিনভর বিজ্ঞাপন পাবার আশায় অফিসে অফিসে ঘুরে। বড় বাবুর তেল মারে। এসব করতে করতে এরা হয় চিটার-বাটপার। মান সম্মান যায় সৎ সাংবাদিকতার। আপনি/আমি তার কাছে গেলে সে মনে করেন বিজ্ঞাপন খুঁজতে গেছি।
আমার কথা যদি বলি; পাহাড় থেকে জাতীয় পত্রিকার কাজ করছি আজ তা প্রায় ৮ বছর। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাধ্যমে জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু। টেলিভিশন সাংবাদিকতার বয়স প্রায় ৬ বছর। ইনডিপেনডেন্ট টিভির মাধ্যমে টেলিভিশন সাংবাদিকতা। যে পত্রিকা ভাল লাগেনি তা ছেড়ে দিয়েছি।
এ অল্প বয়সে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক প্রশিক্ষণ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এ পর্যায়ে এসে আপসোষ করি এই পেশায় আসলাম কেন?
তখন মনে পড়ে প্রবীণ সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় সুনীল দার (সুনীল কান্তি দে) কথা। আমি যখন সাংবাদিকতা করতে শুরু করি তখন তিনি আমাকে বলেন, এই বেকুব (ভালবেসে তিনি নানান নামে ডাকেন। কখনও শুয়রের বাচ্চাও ডাকেন) কোন ভুতে তোমাকে সাংবাদিকতা করতে বলেছে? আসলে তো তাই। তিনি আরো একটি কথা বলেছিলেন এই পেশায় যেহেতু এসেছ তাহলে তোমার পড়াশুনার অর্ধভঙ্গ হতে পারে। আসলে এটি বাস্তব। তার এ কথার কারণে আমি সফলতার ভাবে পড়াশুনা শেষ করতে পেরেছি। তিনি এ কথা না বললে হয়তো আমার পড়াশুনা ঠিকই অর্ধভঙ্গ হয়ে যেত।
সে সময়ে আমি সকাল বিকাল ডেবিট ক্রেডিট করে যেখানে ৩০/৩৫ হাজার টাকা আয় করতে পারতাম সেখানে এখন বেতন পাব কিনা এ অনিশ্চয়তা থাকে প্রতিমাসে। এটি বাংলাদেশের মিডিয়া অঙ্গনের বাস্তবতা। তবে আমি আমার অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছি। কোন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করার মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি। তবে এটি ঠিক এ পেশায় আজকে আছি কালকে নাই। সেভাবে নিজেকে তৈরি করছি।
এ অবস্থায় এখন আমার কাছে অনেকে আসে। তারা সাংবাদিকতা করার আগ্রহ প্রকাশ করে। আমার সাথে কাজ করতে চায়। তাদের আমি উৎসাহিত করি না।
আগ্রহ যেহেতু দেখায় সেহেতু আমি তাদের দুটি প্রশ্ন করি। এ প্রশ্ন হল একটি পড়াশুনা এবং অন্যটি বর্তমান অবস্থা। যারা ¯œাতক বা ¯œাতকোত্তর তাদের নিরুৎসাহিত করে বলি অন্য পেশায় যান। আরা যাদের শিক্ষা কম তাদের বলি যা নিয়ে আছেন তা নিয়ে থাকেন এবং আরো ভাল কিছু করার চেষ্টা করেন। এ পরামর্শ দেওয়ার কারণ হল দেশের মিডিয়ার ভবিষ্যত আমি অন্ধকার দেখি।
দেশে পেশাদারিত্ব মিডিয়া হাউজের সংখ্যা খুবই কম। এসব অপেশাদার মিডিয়া হাউজের মাধ্যমে চিটার-বাটপারি শিখা যায়। সাংবাদিকতা শিখা যায় না। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদ না খুঁজে বিজ্ঞাপন খুঁজে। নিউজ দিলে তা ছাপানোর জন্য উল্টো টাকা খুঁজে।
এছাড়াও এসব হাউজের অসাধু বড় কর্তারা বিনা খরচে ভ্রমণ করতে চায়। এ খরচ জোগাতে গিয়ে ঐ নামধারী সাংবাদিককে চিটার বাটপারী করতে হয়। আর এটি যারা করতে পারে তারা হয় সাংবাদিক। যারা পারে না তারা হতে পারে না।
এখন পাহাড়ে একাধিক প্রিন্ট ও ডটকম পত্রিকা। পাহাড় সম্পর্কিত নতুন ডটকম নাম খুঁজলে আর পাওয়া যায় না। একাধিক সম্পাদক। এদের ঝাঁক ঝাঁক সাংবাদিক। এদের এক একজনের কার পড়াশুনা কি এগুলো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এ ঝাঁক ঝাঁক সাংবাদিক হওয়ায় অনেকের লাভও হয়েছে। আগে কেউ সাংবাদিক সম্মেলন করলে সাংবাদিক পাবে কিনা এ টেনশনে থাকতেন। এখন থাকতে হয় না। বরং আতংকে থাকেন। ভাবেন, বেশী সাংবাদিক আসলে তাদের বসার জায়গা দিতে পারবে কিনা? তাদের জন্য সম্মেলন স্থলে চায়ের কাপ হবে কিনা?
তবে সুবিধাও আছে। দেখা যায়, একজন সম্পাদককে বললে সুন্দর করে সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে যায়। সংবাদ সম্মেলনে তার সাংবাদিক ছাড়াও তিনি তার অফিসের পিয়নকে পর্যন্ত নিয়ে সম্মেলনে হাজির হয়। ফলে অন্য সাংবাদিকদের না ডাকলেও চলে।
এ সব মিলিয়ে পাহাড়ে সাংবাদিকতার কঠিন অবস্থা। সাংবাদিকতার প্রাথমিক ধারণা রাখেন না এমন ব্যাক্তি সম্পাদক হয়ে গেছেন। এরপর এসব সম্পাদক সাংবাদিক সৃষ্টি করেন। এরা এসএসসি পরীক্ষা কিভাবে দেয় তা জানে না। অথচ আলোচনা বিষয়বস্তু বানায় “বিসিএস পরীক্ষা”। তাকে প্রশ্ন করলে সে আমার/আপনার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবে। তখন মাফ চাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এই হল পাহাড়ের সাংবাদিকতা।
এ ধরণের সাংবাদিক প্রতিনিয়ত বাড়ছে পাহাড়ে। আর অনেকে আছে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কমিটিতে পদে আছে। তারা মনে করে দলের কোন অনুষ্ঠানে বেশী ছবি তুলতে পারলে সেটি সাংবাদিকতা। কোন নেতার সাথে সেলফি উঠতে পারলে সেটি সাংবাদিকতা। এসব কাজে সীমাবদ্ধ থাকে এরা। পরিচিতি দেয় সাংবাদিক। নিউজ লিখে না। সারাক্ষণ অন্যর নিউজ, ছবি চুরি করার চিন্তায় থাকে।
এখন কথা হচ্ছে ভাল মিডিয়া হাউজ সৃষ্টি হলে সৃষ্টি হবে ভাল সাংবাদিক। নিজের খাবার খাদ্য নেই আর সে যদি পত্রিকা/টিভি বের করে তাহলে বুঝতে হবে এর উদ্দেশ্য ভাল নয়। ভাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠান হলে যেমন প্রতিষ্ঠান আয় করতে পারে তেমনি ভাল সাংবাদিকতারও চর্চা করতে পারে।
আপত্তি আরো আছে। তা হল এসব লোকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে। ভাল করে লিখতে পারেন না। ১০ শব্দের মধ্যে ৭/৮ টি শব্দ ভুল থাকে! তারা যে আসলে কোন ক্লাশ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে, কোন প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছে তা সঠিকভাবে বলতে পারেন না। অবস্থান ভেদে তারা কখনও বলে সে অনার্স পাশব! কখনও মাস্টার্স পাশ! আজ বলে, আমি রাঙামাটি কলেজে পড়েছি। কাল বলে আমি চবিতে পড়েছি! পরশু বলে, আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়েছি।
এভাবে সকাল বিকাল মিথ্যা কথা বলতে হলে সাংবাদিকতার চর্চা করতে হবে না। কারণ একটি মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে আরো একটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। ফলে সব সময় তাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। এ যদি অবস্থা হয় দেশে মফস্বল সাংবাদিকতার অধপতন হবে।
মিডিয়া হাউজগুলোর প্রতি একটি অনুরোধ; সাংবাদিক হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার আগে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং সাংবাদিকের স্বার্থকে অবশ্যই প্রধান্য দিন। যে কাউকে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি তা দেখে নিন।
শুধু পুরুষ আর নারী এ চেহারা দেখে নিয়োগ দিলে হবে না। যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে তাকে অবশ্যই সরকার নির্ধারিত ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন ভাতা পরিশোধ করার মানসিকতা তৈরি করুন।
আর যিনি নিয়োগ নিবে তাকেও এ সম্পর্ক ধারণা রাখতে হবে। ওয়েজবোর্ডের বাইরে বিনা পয়সায় সাংবাদিকতা করার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
যদি তা না হয় তাহলে সৎ সাংবাদিকদের পরিবর্তে বাটপারদের জয় জয়কার হবে। সৃষ্টি হবে না জ্ঞানী সাংবাদিক। রসাতলে যাবে সাংবাদিকতা।
হিমেল চাকমা,
গণমাধ্যম কর্মী, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন লিমিটেড