রাঙামাটির সহিংসতায় কোটির টাকার ক্ষতি তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা রাসেল চাকমার
প্রকাশঃ ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ ০৪:১৬:১৮
| আপডেটঃ ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৩:৩০:১৮
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। বুদ্ধমুর্তি, চীবর, ভিক্ষাপাত্র ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দানীয় সামগ্রীর কোটি টাকার ব্যবসা ছিল রাসেল চাকমার। প্রিয় স্টোর ও রাসেল স্টোর নামে পাশাপাশি দুটি দোকান নিয়ে শহরের চম্পক নগর এলাকার এস.কে মার্কেটে ব্যবসা করেন তিনি। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় দোকানের মালামাল আর লুট করা হয় শতাধিক পিতলের বুদ্ধমুর্তি।প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন রাসেল চাকমা। ওই ঘটনায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। নিজেদের প্রস্তুত করা একটা সাধারণ ডায়েরী লিখে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে পুলিশ। পুলিশের ভুমিকায় ক্ষুব্ধ হলেও রাসেল চাকমার কিছুই করার সুযোগ ছিলনা।
তবে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছেন নতুনভাবে। ব্যবসা ও পারিবারিক সঞ্চয় থেকে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আবারো শুরু করেছেন চীবর বুদ্ধমুর্তি ও দানীয় সামগ্রীর ব্যবসাটা। কিন্তু বৌদ্ধভিক্ষুদের কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান না করার সিদ্ধান্তে বেশ হতাশ রাসেল চাকমা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে রাসেল চাকমার প্রিয় স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া দোকানটি সংস্কার করে বুদ্ধমুর্তি ও চীবর গুছিয়ে রাখছেন। বলেন, এই দোকানটাই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। এই দোকানটি ছাড়া আমার পরিবারসহ বেঁচে কোন অবলম্বন বা পথ নেই। দোকানে ৫ লাখ টাকার মালামাল তুলেছি। নতুনভাবে দাড়ানোর চেষ্টা করছি। দোকানে বর্তমানে দামী থাইল্যান্ডী চীবর ৩০ জোড়া, নরমাল থাইল্যান্ডী চীবর ৪০ জোড়া, কোরিয়ান চীবর ১০০টি, দোয়াজিক ১০০টি ছোট ও মাঝারি আকারের দেড় লাখ টাকার বুদ্ধমুর্তি সবমিলিয়ে ৫ লাখ টাকার মালামাল তুলতে পেরেছি। পুড়ে যাওয়া রাসেল স্টোরটি এখনো খুলতে পারিনি। আপাতত বন্ধ রেখেছি। দোকানটিও এখনো পোড়া অবস্থায় রয়েছে।
সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেছেন পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও অন্যান্য কর্মকর্তারা। ক্ষতিপুরণের আশ^াস দিয়ে আবেদনপত্র নিলেও পর্যাপ্ত ক্ষতিপুরণের আশা করেন না রাসেল চাকমা। রাসেলচাকমা বলেন, শুনেছি খাগড়াছড়ি ও দিঘীনালায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদেরকে সরকার মাত্র ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছে। সেটা তো দেয়া না দেয়াই সমান। আমরা ১ সেট অষ্ট পরিষ্কার বিক্রি করি ২০ হাজার টাকা। আমার শতাধিক অষ্ট পরিষ্কার সেট, বুদ্ধমুর্তি, চীবর ও দানীয় সামগ্রী পুড়ে গেছে। দেড় কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। রাসেল স্টোরে ৯২ লাখ টাকা ও প্রিয় স্টোরে ৬২ লাখ টাকার মালামাল ছিল বলে দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্থ রাসেল চাকমা। অগ্রণী ব্যাংকে ৫০ লাখ ও ব্র্যাক ব্যাংকে ১৫ লাখ টাকার ঋণ আছে বলেও জানান তিনি।
রাসেল স্টোরের সামনে ভাসমান দোকান ছিল চম্পক নগরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব নির্মল কান্তি চাকমার। ভাসমান দোকানে পান-সিগারেট, বনাজী ওষুধ, বিস্কুট ও মোমবাতি বিক্রি করে জীবিকা তার। পারিবারিক খরচের জন্য তার মেয়ে ৬ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন নির্মল কান্তি চাকমাকে। সেই টাকা খরচ না করে দোকানটাতে বিনিয়োগ করেছিলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর দোকানে বেনসন সিগারেট, বিস্কুটের প্যাকেট, মোমবাতি ও বনাজী ওষুধ কিনে রেখেছিলাম। রাতে ওসব মালামাল রাসেল স্টোরে রেখে গিয়েছিলাম, ঘটনারদিন আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে যায় বলেন নির্মল কান্তি চাকমা। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন পত্র ও রাঙামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ক্ষতিগ্রস্থ হিসেবে নাম দিয়েছেন। ক্ষতিপুরণের আশায় বসে আসেন নিঃস্ব নির্মল চাকমা।
রাসেল স্টোরের পুর্ব দিকে কিছু দুরে লাইফ কেয়ার ফার্মেসী দিয়ে ওষুধের ব্যবসা করেন ইষ্পিত চাকমা। পুড়ে যাওয়া দোকানে আরো ওষুধ তুলে ব্যবসা শুরু করেছেন তিনিও। সবমিলিয়ে অর্ধকোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তার। সম্প্রতি দোকানে ৫ লক্ষাধিক টাকার মালামাল তুলেছেন বলে জানান।
এছাড়া এসকে মার্কেটে সাংবাদিক অফিস, টেলিটক অফিস ও একটি এনজিও অফিসে আগুন দেয়া হয়।
২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অনিক কুমার চাকমা (১৯) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল বাঙালী যুবক। আহত হন বহু পাহাড়ি তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থী ও কয়েকজন বাঙালী। সহিংসতায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় ২২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হয়। ১১টি বসতবাড়িতে আগুন ও ৭টি বসতবাড়ি ভাংচুর করা হয়। লুটপাট করা হয় একটি বৌদ্ধ বিহারের দানবাক্সের টাকা ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল। জেলা প্রশাসনের গঠিত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কমিটির তথ্যমতে, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৯ কোটি ২২ লাখ টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে অনিক হত্যা মামলায় গত বুধবার (৯ অক্টোবর) মোহাম্মদ জালাল (২৫) নামে এক যুবককে আটক করে রাঙামাটির কোতয়ালী থানা পুলিশ। একইদিন গত ২০ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় নাশকতার মামলায় সজিব চাকমা নামে এক তরুণ ও অনুপম চাকমা নামে এক সিএনজি অটোরিক্সা চালকে আটক করা হয়েছে। এর আগে গত ৩ অক্টোবর খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থেকে মোহাম্মদ রুবেল (২৩) নামে এক যুবক ও ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া নাশকতার মামলায় মোঃ রাকিব নামে ২৭ বছর বয়সী এক তরুণকে আটক করা হয়। এ পর্যন্ত অনিক হত্যা মামলায় ৩ জন ও নাশকতার মামলায় ৪জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহেদ উদ্দিন। ।
উল্লেখ্য গত ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর দিঘীনালা ও খাগড়াছড়িতে ৩জন পাহাড়িকে হত্যা, দোকানপাট-বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে রাঙামাটি শহরে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি শহরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনিক কুমার চাকমা নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন অনিকের বাবা আদর সেন চাকমা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন বলে জানায় রাঙামাটি কোতয়ালী থানা পুলিশ।