প্রকাশঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১০:৪৯:৫৯
| আপডেটঃ ২০ নভেম্বর, ২০২৪ ০৮:২৮:৩৫
সিএইচটি টুডে ডট কম, কাপ্তাই (রাঙামাটি)। যোগদানের চারমাস পর বদলি হয়েছেন রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন। গত ৬ মে তিনি কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসনে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। এই চার মাসেই তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে তিনি উপজেলাবাসীর মন জয় করেছেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন।
গত ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) শংকর রঞ্জর সাহার স্বাক্ষরিত এক আদেশে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় তাকে বদলি করা হয়। জানা গেছে, আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর সম্ভাব্য তারিখে তিনি কাপ্তাই থেকে বিদায় নিয়ে হাটহাজারি উপজেলায় ইউএনও পদে যোগদান করবেন।
রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে যোগদানের পর থেকেই তিনি শিক্ষা, মাদক, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে গেছেন। তাঁর এমন কাজে কাপ্তাইয়ের মানুষ বলেছেন, তাঁরা একজন দক্ষ ও যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা পেয়েছেন। যোগদানের এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি স্থানীয় জনসাধারণের মন জয় করে নিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, ইউএনও রুহুল আমিন ছিলেন খবুই সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা। যিনি সরকারের সেবা জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ছিলেন বদ্ধপরিকর।
মাদক, ইভটিজিং ও দুর্নীতির বিষয়ে ছিলেন কঠোর-
মাদক ও ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেঞ্জে কাজ করেছেন ইউএনও রুহুল আমিন। সেখানেই মাদকসেবীর উপদ্রব, সেখানেই উপস্থিত হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর যার নেতৃত্বেই ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমিন। রাত-দিন বলে ছিলো না কোনো পার্থক্য।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত সাড়ে তিন মাসে ২৫ জন মাদকসেবীকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। তাঁর এমন পদক্ষেপ দেখে মাদকসেবী নিজ সন্তানকেও প্রশাসনের কাছে তুলে দিলেন এক বাবা।
আজকের সমাজে এখন আরেক ব্যধির নাম ইভটিজিং (উত্যক্ত করা)। রাস্তাঘাটে সেখানেই যখন শিক্ষার্থীদের উত্যক্তের খবর পেয়েছেন। ঠিক তখনই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে উত্যক্তকারীকে দিয়েছেন সাঁজা। অভিভাবকদেরও বলেছেন যখনই আপনার সন্তান এ ধরণের কার্যক্রমের সম্মুখীন হবে; সাথে সাথেই প্রশাসনকে অবহিত করবেন। প্রশাসন অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিবে।
কেবল মাদক প্রতিরোধ ও ইভটিজিং প্রতিরোধেই বসে ছিলেন না তিনি। ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। কাপ্তাইয়ে আসার পর বিভিন্ন সময়ে কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারগুলোতে চালিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। অভিযানে দুর্নীতির কারণে বন্ধও করে দিয়ে ছিলেন কয়েকটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। এছাড়া অভিযান পরিচালনা করে জনসম্মখে তুলে এনেছেন ফার্মেসীর ভিতরে মাদক বিক্রির আখড়ার কথা।
এছাড়া এবছর পুলিশের ট্রাফিক সপ্তাহে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করেছেন অসংখ্য যানবাহনকে। এরমধ্যে মামলা দিয়েছেন ১৪৬ যানবাহনকে। এরমধ্যে ছয়টি যানবাহন জব্দ করা হয়। যেসব যানবাহন গুলোর বেশির ভাগেরই ছিলো না ফিটনেস। কোনটার ফিটনেস থাকলেও নেই ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স। এরমধ্যে হেলমেট ব্যবহার ছাড়া মোটরসাইকেল আরোহী ছিলো অসংখ্য।
শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নই ছিলো তাঁর নেশা:
দায়িত্বরত নেওয়ার পর থেকেই তিনি বলে চলেছেন শিক্ষাক্ষেত্রে অন্য সবের চেয়ে তাঁর আগ্রহ একটু বেশিই। এও বলেছেন, আজকের শিশুরাই আগামীদিনের নেতৃত্ব দিবে। তারাই জয় করবে বিশ্ব। তাই তাদের বেড়ে উঠতে হবে পড়াশুনা ও সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে। এরাই আগামীদিনে মানবিক জাতি গঠন, মানবিক দেশ গঠনে নিজেদের শ্রম দিবে।
উল্লেখ্য যে, তিনি এই সময়েই কাপ্তাইয়ের রাইখালী ইউনিয়নের ডংনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের অনুপযোগী বেঞ্চ অপসারন করে নতুন বেঞ্চ প্রদান করেন। যেখানে বিগত ১৬ বছরেও কোনো ইউএনও কিংবা উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি কর্মকর্তা আগমন ঘটেনি। কিন্তু তিনি দেখিয়েছে অদম্য সাহসিকতা। পায়ে হেটে পৌঁছেছেন দূর পাহাড়ি গ্রামের এসব স্কুলে।
এর মধ্যে রাইখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত ভালুকিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সোলার স্থাপন করেন। কেপিএম উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিলো না বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা; খবর পাওয়ার পরক্ষনেই তিনি বিদ্যালয়ে গভীর নলকূপ বসানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এখন সেই কর্ণফুলি পেপার মিল (কেপিএম) স্কুলের শিক্ষার্থীরা পান করছে বিশুদ্ধ পানি। ইউএনও’র এমন উদ্দ্যোগেই বিশুদ্ধ পানির সংকট গোছালো এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের। এছাড়া অসহায় ও নিন্মবিত্তের পরিবারের ছেলে মেয়েদের হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন বই।
এছাড়া ওয়াগ্গা ইউনিয়নের শিলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন শৌচাগারের। অথচ এর আগে শৌচাগার থাকলেও সেটি নষ্ট হওয়ার পর কোনও পদক্ষেপ না নেওয়াতেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে ছিলো। যার কারণে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রাকৃতিক কাজ আশপাশের বাড়িতেই সারতো। ইউএনও রুহুল আমিন কাপ্তাইয়ের বিভিন্ন গ্রামে চষে বেড়িয়ে করেছেন আরও অনেক জনবান্ধন কাজ। এরমধ্যে আছে বিদ্যালয়
যোগদানের মাসের মাথায় কাপ্তাইয়ের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাদক ও যৌন আখড়ার খবর পেয়ে সাথে সাথে অভিযান পরিচালনা করে ইয়াবা সেবনের জিনিসপত্র, যৌন উত্তেজক টেবলেটসহ নৈশ প্রহরীকে আটক করা হয়। এছাড়া উপজেলা পরিষদ কমপেক্সে এবং এর আশপাশে বসবাসরত শিশুদের জন্য নির্মাণ করা হয় ‘শিশুরাজ্য’ নামক একটি শিশু পার্ক ।
এসব প্রসঙ্গে কাপ্তাইয়ের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নাদির আহমেদ বলেন, ‘উনি সরকারের বিধি মোতাবেক কাজ করে গেছেন। উনার একটাই কথা ছিলো সরকারের বিধি মোতাবেক কাজ করে গেলে সাধারণ মানুষ ও সুবিধাভোগীরা তাদের সেবা নিশ্চিতভাবে পাবে। বিশেষ করে তিনি সুবিধাবাদী চক্রদের বিরোধী ছিলেন। তিনি মাদক, বাল্য বিবাহসহ সামাজিক কাজে ছিলেন খুবই কঠোর। ’
এই শিক্ষা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমি বলবো তিনি সততার প্রশ্নে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি কাপ্তাইয়ে যতদিন দায়িত্ব ছিলেন, আমাদেরকে নিয়ে তিনি জনগণের দোড়গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন।
দুস্থ অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি:
কাপ্তাই যে কয়েকমাস দায়িত্ব পালন করেছেন ইউএনও রুহুল আমিন। এতেই তিনি দাঁড়িয়েছেন দুস্থ ও অসহায়দের পাশে। কাউকে নিজে ভর্তি করিয়েছেন হাসপাতালে, কাউকে করে দিলেন নতুন করে মাথা ঘোঁজার স্থান।
রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার বরইছড়ি এলাকার ছাদ হতে পড়ে যাওয়া মো সেলিম নামে একজন দিনমজুরকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন তিনি। এতে পা ভাঙা সেলিম সুস্থ হয়ে স্বচ্ছল জীবনযান করছে। তিনি চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের শৈলজা এলাকার বিধবা হাজেরা বেগমের ভাঙা ঘর করে দিলেন মেরামত। এর মধ্যে উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের দুই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ঘর তোলার জন্য নগদ অর্থসহ টিন বিতরণ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, একই ইউনিয়নের কয়লার ডিপু এলাকার বাসিন্দা সোহাগীকে প্রশাসের সহায়তায় নতুন ঘর তৈরি করেছেন এই ইউএনও। অথচ দীর্ঘদিন ধরে দুইকক্ষের জরাজীর্ণ একটি ঘরে থাকছে হলো সোহাগী পুরো পরিবারকে। বৃষ্টির দিনে আশ্রয় নিতে হতো অন্যের ঘরে। এখন প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন ঘর পেলো তারা।
কাপ্তাইয়ের স্থানীয় সাংবাদিক নজরুল ইসলাম লাভলু বলেন, আমি বলবো উনি এককথায় খুব ভালো মানুষ ছিলেন। উনি সহযোগীতার মনোনভাবে আমাদের সাথে নিয়ে পুরো কাপ্তাই চষে বেড়িয়েছেন। তৃনমূলের পর্যায়ের কাছে কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন। এমন হয়েছে আমরা কোনো ধরণের খবর পাইনি। কিন্তু উনি খবর পেয়ে দুর্গম পাহাড়ে পৌঁছে গেছেন। এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন বিরোদী কর্মকান্ড চোখে পড়াই তিনি জনপ্রতিনিধিদেরও শাসিয়েছেন। আমাদের মাঝে উনাকে আরও অনেক প্রয়োজন ছিলো।
কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দিলদার হোসেন বলেন, ইউএনও সাহেব এক কথায় খুবই জনবান্ধব, দেশপ্রেমিক ও কর্মযজ্ঞ মানুষ। কাপ্তাই থাকাকালীন এই সময়ে এখানে কিছু মৌলিক পরিবর্তনের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। সমাজে কুসংস্কার দূরীকরণ ও তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি তাঁকে আরও কিছুদিন এখানেই চাই।
ইউএনও রুহুল আমিন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আসলে চারমাস খুব অল্প সময়। এই চারমাসেই কাপ্তাইবাসীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কাপ্তাইয়ের মানুষ আমাকে খুব আপন করে নিয়েছে। এর আগে অন্যান্য বদলির সময় আমার এমনটা খারাপ লাগেনি, যা এখন লাগছে। এখান থেকে যেতে মনে হচ্ছে আমি একেবারেই দেশ ছেড়েই চলে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, যেখানে থাকি না কেন , ‘আমার প্রতি কাপ্তাইবাসীর দোয়া থাকবে এটা আমরা বিশ্বাস। এই কাপ্তাই উপজেলার যেকোনো ধরণের কাজ করতে কখনোই আমাকে বেগ পেতে হয়নি। সবাই আমরা জন্য দোয়া করবেন। সেখানেই থাকি না যেনো মানুষের জন্য কাজ করতে পারি। মানবিক সমাজ গঠনে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পারি।’