প্রকাশঃ ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৬:১৬:১৪
| আপডেটঃ ১৭ নভেম্বর, ২০২৪ ০৫:৩৩:৩৬
সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। কষ্টের জীবন থেকে যমজ মেয়ে দুটো এমন সুনাম বয়ে আনবে তা, ছোটকাল থেকেই অনুমান করে আসছিলেন রিপ্রু মগ ও আপ্রুমা মগিনী। এঁরা ভারতকে সাফ ফুটবলে দুর্দান্ত গোলে হারিয়ে দেয়া আনাই মগিনী’র প্রিয়তম মা-বাবা।
খাগড়াছড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র ‘শাপলা চত্বর’ থেকে সাত কিলোমিটার দূরের সাতভাইয়া পাড়া বলতেই মানুষ ধরে নেয়, ‘ফুটবল কন্যা আনাই-আনুচিং’দের বাড়ি। মূল সড়ক থেকে বাড়ি যাবার পথে গভীর এক ছড়া পাড়ি দিতে হয় ঝুঁকিপূর্ন সাঁকো দিয়ে। সেই গ্রামের দরিদ্র পরিবারের যমজ কন্যা ‘আনাই ও আনুচিং মগিনী’। গেলো বুধবার সাফ অনূর্ধ্ব -১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে আনাই মগিনীর একমাত্র গোলে পাল্টে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের ইতিহাস। ইতিহাস গড়া সেই মেয়েটির প্রশংসায় ভাসছে গোটা নেট দুনিয়া এবং পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে সাতভাইয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেসা ফুটবল টুর্নামেন্ট-এ সফল অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একসাথে যমজ দু বোনের ফুটবল যাত্রা শুরু হয়। পঞ্চম শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার সময় বিপত্তি ঘটে বাবার অনটনে।
আনাই-আনুচিং’র বাবা রিপ্রু মগ সেদিনের স্মৃতি হাতরিয়ে বলেন, চার ছেলে চার মেয়ের মধ্যে তারাই সবার ছোট। মানুষের জমিতে মজুরী খেটে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতাম। তাই ছেলেরা রেখাপড়া শেষ না করেই কায়িক শ্রমে জড়াতে বাধ্য হন। স্থানীয় ব্যাটালিয়ন হাইস্কুল (এপিবিএন হাইস্কুল)-এ আমার আরও এক মেয়ে তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো। যমজ আনাই আর আনুচিংকে ভর্তি করাতে যেয়ে আমার কাছে পাঁচ টাকা কম ছিলো। সেদিন ভর্তি না করিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। পরে আরেকদিন অন্যদের কাছ থেকে টাকা নিয়েই মেয়েদের ভর্তি করেছিলাম। এখন সে কথা মনে হলে দুচোখ জুড়ে জল নেমে আসে।
তিনি জানান, ২০১০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে তাঁর মেয়েদের সফলতার পেছনে মাননীয় সরকার প্রধান এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
রিপ্রু মগ বলেন, মেয়েদের ক্রীড়া নৈপূণ্য জেনে রাঙামাটি জেলার তৎকালীন মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহৃদয়বান প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা ঘাগড়া হাইস্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেন। তাঁর অবদান কখনো ভোলার নয়। তাঁর সুবাদে কাউখালীর সুইলামং মারমা প্রথমে জাতীয় আনসার দলে খেলার সুযোগ করে দিলে পরের বছর জাতীয় দল দুই মেয়েকে স্বাগত জানান।
আনাই-আনুচিং’র মা আপ্রুমা মগিনী বলেন, আমার দুই মেয়ের যখন একসাথে জন্ম হয়, তথন সংসারে অনেক অভাব। ঠিকমতো মেয়েদের দুধ খাওয়াতে পারতাম না। ক্ষুধার জ্বালায় মেয়েরা সারারাত কান্নাকাটি করতো। দুধের বদলে চালের গুড়া পানিতে গুলিয়ে গরম করে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতাম।
তিনি আবেগে ভারী কন্ঠে বলেন, এক পর্যায়ে তাদের বাবাসহ আলাপ করে মেয়ে দুটিকে কারো কাছে পালক (দত্তক) দেয়ার মতো নিষ্ঠুর চিন্তাও মাথায় ভর করেছিলো। সৃষ্টিকর্তা আমাদের দু:খ ঘুচিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার কষ্টে গড়া সেই যমজ মেয়েরাই পুরো দেশ ও জাতিকে দু:খ ভোলাচ্ছে; এর চেয়ে সুখ আর কী হতে পারে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রে¤্রাচাই মারমা বলেন, আমার দুই ভাতিজী ছোটকাল থেকেই খেলাধুলায় খুব আগ্রহী ছিলো। এবারের সাফ ফুটবলে জয় ছিনিয়ে প্রমাণ করেছে, তারা এখন চৌকষ খেলোয়ার। তরা যাতে ভভিষ্যতে বিশ্বকাপ খেলে দেশের মুখ উজ্জল করতে পারে; সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরো সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা চাই তারা দুই বোন আরো অনেক এগিয়ে যাক।
সাতভাইয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মিননাথ ত্রিপুরা জানান, এই শিশুরা যখন আমাদের স্কুলে ভর্তি হন, তখন থেকেই দুরন্ত ছিলো। দৌড়াদৌড়ি আর লাফালাফিত সারাদিন স্কুলকে সরগরম করে রাখতো। যখন বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেসা ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হলো তথন এই দুই মেয়েই দেখিয়ে দিয়েছে, ছোট ছোট কন্যা শিশুরা কতোটা ভালো খেলতে পারে।
দেশ ছাড়িয়ে যখন একের পর এক দুই ছাত্রীর সফলতার গল্প দেখি-শুনি তখন গর্বে মনটা ভরে উঠে। আমাদের বিশ্বাস যমজ কন্যারা বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।
আনাই মগিনী’র বৌদি রাং মে সু মগিনী বলেন, ২০১০ সালে বৈবাহিক সূত্রে তাদের বাড়িতে আসি। এসেই দেখি তারা ছেলেদের পোশাক পরে আর ফুটবল নিয়ে খেলা করে। পরে দেখি তাদেরকে টেলিভিশনে দেখায় আর বাড়িতে ঘন ঘন সাংবাদিকরা আসেন। আমরা পরিবারের সবাই তাঁদের খেলা দেখার সময় শুধু ভগবানকে ডাকি আর চোখে জল নিয়ে থাকি। ওরা ভালো খেলতে না পারলে আমরা কান্না করে দেয়।
খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা বলেন, আনাই মগিনী পুরো দেশের গর্ব। তাঁকে এখন আর কোন বিশেষ জেলার মানুষ হিশেবে পরিচিত নন। জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা আনাই মগিনীকে অভিনন্দন। পাশাপাশি তাঁর বাড়ি যাবার পথটি সেতুসহ সুগম করে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।
খাগড়াছড়ি’র জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, জেলার নারী খেলোয়ারদের বহুমুখী প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। আনাই মগিনী, তার যমজ সহোদও আনুচিং; তারা দুজনই ভালো খেলোয়ার। অভিনন্দন আনাইয়ের প্রতি। তার এবং তার পরিবারের প্রতি জেলা প্রশাসনের ভালোবাসা থাকবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, ছুটিতে বাড়ি ফিরলে আনাই মগিনীসহ জেলার কৃতী খেলোয়ারদের একটি বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা পরিষদ। এছাড়া তার বাড়ি রাস্তা ও বাড়ির পাশের ছড়ার ওপর সাঁকো’র পরিবর্তে কালভার্ট নির্মাণ করে দেয়া হবে।
খাগড়াছড়ি সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী পদ-মর্যাদার শরণার্থী টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, এতো উচ্চতার ক্রীড়া নৈপূণ্য এর আগে খাগড়াছড়ির কোন মেয়ে দেখাতে পারেনি। কিশোরী বয়সে এমন উত্থানে জেলাবাসীর সাথে আমিও উচ্ছ্বসিত। একজন জনপ্রতিনিধি হিশেবে যখন যেখানে যা করা দরকার কৃতী খেলোয়ারদের তাই করা আমাদের দায়িত্ব।