প্রকাশঃ ২৮ জুনe, ২০১৯ ০৬:২০:৫৪
| আপডেটঃ ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ০১:৩৬:৩৮
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পর সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। ১৯৯৭ সনের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির পর একটি পক্ষ বের হয়ে গিয়ে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ইউপিডিএফ নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলে। জেএসএস ও ইউপিডিএফ দুটি সংগঠনের মধ্যে আধিপত্যে বিস্তারের লড়াইয়ে এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে কয়েকশ নেতা কর্মী ও সাধারন মানুষের প্রাণ যায়।
২০০৮ সালে জরুরী অবস্থার সময় আবার জেএসএস ভেঙ্গে জেএসএস সংস্কার নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলে ও সুধা সিন্ধু খীসা। এসময় চলতে থাকে ত্রিমুখী সংঘাত, ২০১৫ সন থেকে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ২০১৭ সন পর্যন্ত বন্ধ ছিল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত। ২০১৭ সনের নভেম্বর মাসে আবার ইউপিডিএফ ভেঙ্গে নতুন ইউপিডিএফ সংস্কার নামে আরেকটি সংগঠন হয়। ইউপিডিএফ সংস্কার হওয়ার পর আবারো পাহাড়ে শুরু হয় রক্তের নির্মম হোলি খেলা। ইউপডিএফ সংস্কার শুরুতে মুল ইউপিডিএফের গুরুত্বপুর্ণ নেতাদের হত্যাসহ জেএসএস নেতা কর্মীদের হত্যা শুরু করে।
নানিয়াচর উপজেলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস সংস্কারের সহ সভাপতি এডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে ২০১৮ সনের ৩ মে দুবৃর্ত্তরা হত্যা করে, নিহত এডভোকেট শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় যোগ দিতে ৪ মে খাগড়াছড়ি থেকে নানিয়াচর যাওয়ার পথে ইউপিডিএফ সংস্কারের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ ৬জন নিহত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতিপুর্বে আঞ্চলিক দলগুলোর রেশারেশি এবং গুলিতে কেউ মারা গেলে মামলা হতো না, তবে ২০১৪ সনের সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আওয়ামীলীগ সন্ত্রাস চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার আন্দোলন শুরু করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবার মামলা করা শুরু করেছে।
তারই ধারাবাহিকতায় নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ও ইউপিডিএফ সংস্কারের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি পৃথক মামলায় ইউপিডিএফের প্রধান প্রসীত খীসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের নেতা কর্মী, ইউপিডিএফ সমর্থিত জনপ্রতিনিধি এবং মুল জেএসএসের সন্তু লারমা এবং উষাতন তালুকদারকে বাদ দিয়ে বাকি কেন্দ্রীয় ও জেলা ও উপজেলা নেতাদের আসামী করা হয়েছে।
মামলার পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানের মুখে অধিকাংশ নেতা কর্মী পালিয়েছেন, ঘর বাড়ি ছাড়া। এছাড়া জেএসএসের মুল চাঁদা কালেক্টর জ্ঞান শংকর চাকমাসহ বেশ কয়েকজন নেতা এর মধ্যে নিহত হয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরে খোঁজ নেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধি প্রিয় ওরফে সন্তু লারমার প্রিয়ভাজন রাজনৈতিক সহকারি বরুন চাকমার। কেউ কেউ বলছেন বরুন চাকমা জেএসএস সংস্কারে যোগ দিয়েছেন। একদিকে জেএসএসের নেতাদের নামে মামলার কারণে তারা এলাকা ছাড়া অন্যদিকে সন্তু লারমার প্রিয় ভাজনরা নিঁেখাজ, আত্বগোপনে বা জেএসএস সংস্কারে যোগ দেয়ায় অনেকটা কঠিন সময় পার করছে সবচেয়ে পুরানো আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি।
জনসংহতি সমিতির একটি সুত্র মতে ২০১৯ সালে এ পর্যন্ত ৪টি মামলা হয়েছে ১০০ জন নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের মধ্যে ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ৫টি মামলায় ১১৭ জনকে জড়ানো হয়েছে এবং ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৭ সালে ১৬১ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ১৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নভেম্বর ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত সময়ে রাঙামাটি জেলাধীন জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও রাঙামাটি সদর উপজেলায় ১০ টি মামলায় ১৮৭ জনকে ফাঁসানো হয়েছে। ২০১৬ সালে বান্দরবনে ৭জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ ১৫০ জন জেএসএস কর্মী ও আদিবাসী অধিকারকর্মীদের সাজানো ও মিথ্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তাদের মধ্যে ৪০জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ১৫০জন সমাজকর্মীকে এলাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেএসএস নেতা বলেছেন, সরকার সমতল ভুমির মত পাহাড়ে দমন পীড়ন চালাচ্ছে, মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে, মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। অথচ সরকার জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি করেছে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলছে। চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন যারা করছে সরকার কেবল তাদের উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে। আজকে পাহাড়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফ সংস্কার নামে দুটি সংগঠন সন্ত্রাস চালাচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে, মানুষ খুন করছে তাদের তো গ্রেফতার করছে না। আর জেএসএস নেতা কর্মীরা চুক্তির পক্ষের হয়েও বাড়ী ঘরে থাকতে পারছে না।
তিনি আরো বলেন, ক্ষমতাসীন দল ২০১৮ সনের সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৯ সনে উপজেলা নির্বাচনে জেএসএস প্রার্থীর পক্ষে যেন নেতা কর্মীরা কাজ করতে না পেরে সে জন্য মামলা দিয়ে দৌড়ের উপর রেখেছে সরকার। যদি এটি কেন্দ্রীয় সরকারের নয় স্থানীয় আওয়ামীলীগের পলিসি।
১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়, ১৯৭৫ সনে পাহাড়ে স্বায়ত্বশাসন ও জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি এবং পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতির অধিকারের জন্য সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। পাহাড়ে একমাত্র আধিপত্যে বিস্তার করে থাকা সংগঠনটি ১৯৯৭ সনের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি এবং অস্ত্র জমাদানের মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে। শান্তি চুক্তির পর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সংগঠনটি কার্যক্রম চালালেও ২০১৭ সনের পর থেকে কঠিন সময় পার করছে।