শুক্রবার | ২৯ মার্চ, ২০২৪
পার্বত্য শান্তি চুক্তির রজত জয়ন্তী

পাহাড়ে ২৫ বছরেও ফিরেনি কাঙ্খিত শান্তি, রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জেএসএসের

প্রকাশঃ ০১ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:২৬:০২ | আপডেটঃ ২৯ মার্চ, ২০২৪ ০৫:৩৭:০১
ষ্টাফ রিপোর্টার, রাঙামাটি। কাল পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পুর্তি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২৫ বছরেও পাহাড়ে শান্তি আসেনি। বন্ধ হয়নি রক্তপাত, হানাহানি। একের পর এক পড়ছে লাশ। আঞ্চলিক দলের একাধিক বৈরি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে প্রতিনিয়তই ঘটছে সংঘাত। চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। এতে জিম্মি পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। তবে জেএসএস নেতাদের অভিযোগ সরকারের  ছত্রছায়ায় চুক্তিকে বাঁধাগ্রস্ত করতে  নতুন নতুন সংগঠন জন্ম নিচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক চিহ্নিত করে এর স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ঐতিহাসিক এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়- যেটি ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’ হিসাবে সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ শর্তাবলি আজও অবাস্তবায়িত। বর্তমানে পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিরাজ করছে স্থবিরতা। ফলে পাহাড়ের পরিস্থিতি দিন দিন জটিলতার দিকে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য, সাধারণ থেকে শুরু করে স্থানীয় বিভিন্ন মহলের। তবে চুক্তির ফলে উন্নয়নের দ্বার উন্মাচিত হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে পাহাড়ে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের মতবাদ নিয়ে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর শুরু হয় জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ইউপিডিএফের মধ্যকার সংঘাত আর রক্তপাত। ঘটে বহু মানুষের প্রাণহানি। পরে দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে জনসংহতি সমিতি ভেঙে দুই দলে বিভক্ত হয়। জন্মলাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামে আরেকটি আঞ্চলিক দল। সর্বশেষ ২০১৭ সালের শেষের দিকে ইউপিডিএফ ভেঙে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গঠিত হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি আঞ্চলিক সংগঠন। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে তৈরি হয় সংকট। ওই চারটি দলের মধ্যে বেড়ে যায় সংঘাত আর হানাহানি। এরমধ্যে আবার নতুন করে জন্ম নেয় কুকি চীন ন্যাশনাল পার্টি।

গত ২৫ বছরে ভ্রাত্বঘাতিসহ নানামুখী সংঘাতে অন্তত ১ হাজার মানুষ মারা যায়, ঘটেছে অপহরণ সাম্প্রদায়িক হামলা। সবশেষে গত ১৪ নভেম্বর কুকি চীন ন্যাশনাল পার্টির হামলায় বান্দরবানে ডিজিএফআই কর্মকর্তা ও গত ৩০ নভেম্বর বুধবার বাঘাইছড়ির সাজেকে এক মোটর সাইকেল চালককে গুলি করে হত্যা করে।  

রাঙামাটির সাবেক সাংসদ ও জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি উষাতন তালুকদার এমপি বলেছেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে নানা ধরনের তালবাহনা করছে। চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেই মামলা হামলা করে হয়রানি করা হয়। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য সরকারের স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন গ্রুপ সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেনি, জেলা পরিষদে পুলিশ, ভুমি, বনসহ গুুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো হস্তান্তর করা হয়নি। ভুমি কমিশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শরাণার্থী বিষয়ক বিষয়ক টাস্কফোর্স মুলত অকার্যকর। জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকরা হয়নি। সরকার কেবল গানিতিক হিসাব করছে। গানিতিক হারে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, এর জন্য সরকারকে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
 
রাঙামাটি শহরের বনরুপা সমতাঘাটের দোকান ব্যবসায়ী মুক্ত কিশোর চাকমা বলেন, মনে হচ্ছে শান্তি চুক্তি আর বাস্তবায়ন হবে না। চুক্তির ২৫ বছরেও যেখানে ঝুলন্ত রয়েছে, সেখানে পূর্ণবাস্তবায়নের আশা করি কিভাবে । এ নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা তেমন কোনো লক্ষণীয় নয়।  


ইউপিডিএফ নেতা অংগ্য মারমা বলেছেন, চুক্তির ২৫ বছরপূর্ণ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসেনি। পাহাড়ে এখনো বিপুল সংখ্যক সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি, প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল, গত ২৫ বছরে পাহাড়িদের উপর কমপক্ষে ১৯টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা, সব সময় ভীতিকর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হওয়া শান্তি ফিরে না আসার বড় প্রমাণ। সরকার গত আগষ্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এখানে শান্তি থাকলে, সবকিছু ঠিক মত চললে অনুমতি  না দেয়ার তো কোন মানে হয় না। চুক্তি ২৫ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি আসেনি - এই সত্য  সরকার বাইরের দুনিযার কাছে লুকোতর চাইছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তিকে নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উভয়পক্ষ সরকার ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পাহাড়ি জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে। যে চুক্তি ২৫ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি নিয়ে আসতে পরেনি সে চুক্তির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান পালনের নামে আনন্দ উল্লাস পাহড়ি জনগণের সাথে তামাশার সামিল।  


এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেছেন, পার্বত্য চুক্তি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এই চুক্তির মাধ্যমে বাঙালীসহ পাহাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি সত্বার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। পাহাড়ে শান্তির চুক্তি করেছেন সন্তু লারমা কিন্তু পাহাড়ে শান্তি ফিরেনি, তাই তার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারে থাকার কোন অধিকার নেই, পদত্যাগ করা উচিত। পাহাড়ে শান্তি সস্থাপন করতে হলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে এবং চুক্তির অসম ধারাগুলো সংশোধন করতে হবে। প্রত্যাহারকৃত সেনাকাম্প পুন:স্থাপন করতে হবে।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুপ্রু চৌধুরী বলেন, অস্ত্র দিয়ে কোন সমস্যার সমাধান হয় না, সমস্যা থাকলে জেএসএসকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের রোডম্যাপ কি হবে সেটা জেএসএস ঠিক করে দিক, যদি সরকারের সাথে তাদের মতের মিলা হয় নিশ্চয় সরকার সেটা বিবেচনা করবে।  

রাঙামাটি আসনের সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেছেন, চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে এরই মধ্যে ৪৮টির বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়নাধীন। পার্বত্য শন্তিচুক্তি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে- তার মানে বলা যায়, ইতিমধ্যে শান্তি চুক্তির ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ সরকারই শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করছে পাহাড়ে অবস্থান নেয়া অবৈধ অস্ত্রধারীরা। পাহাড় থেকে সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হলে অচিরেই পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন সহজ হবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরপরই পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে।

তিনি আরো বলেন, শান্তি চুক্তির ফলে পাহাড়ে উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান হয়েছে, একটি মহলের বিরোধীতা সত্বেও পাহাড়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। বরকলের ঠেগামুখে স্থল বন্দর স্থাপনের কাজ চলছে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির রজত জয়ন্তী উপলক্ষে সরকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, সেনাবাহিনী, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাঙামাটিতে দিনটি উপলক্ষে র‌্যালী, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্টিত  হবে।


এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions