‘কর ফাঁকি’র পাহাড়ে নজর পড়ুক সরকারের -প্রদীপ চৌধুরী
প্রকাশঃ ০৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০৯:৩৫:৩৭
| আপডেটঃ ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১২:০৮:১২
আজকের দৈনিক সমকাল পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর প্রথম শ্রেণীর দুর্নীতি’। সংবাদটি পড়ে সমতলের যেকোন পাঠক আহাম্মক বনে গেলেও পাহাড়ের পাঠকদের কাছে এটি একটি মামুলি খবর। কারণ, তিন পার্বত্য জেলায় তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এমন দৃশ্য একেবারেই সাদামাটা। তবে অনেক সরকারী কর্মচারীর সন্তান-সন্ততি বা নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতা পেয়েই বাড়ি-গাড়ির মালিক হবার নজির থাকতে পারে।
আমার শহর খাগড়াছড়িতে যদি পাঁচ শতাধিক পাকা দালান থেকে থাকে তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দালানের মালিকই সরকারের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী।
নিজের শহর ছাড়াও এ ধরনের কর্মচারীদের ঢাকা-চট্টগ্রামেও কারো কারো নামে-বেনামে ফ্ল্যাট-প্লট এবং গাড়ি-বাড়ির খবর পেশাগত কারণে কানের কাছ দিয়ে ঘুর ঘুর করে।
যে শহরে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের এমন সৌভাগ্য সে শহরের অন্যসব ক্ষমতাবানদের অবস্থা নিশ্চয়ই সহজেই অনুমেয়।
মজার বিষয় হলো, খাগড়াছড়িতে মাঝে মাঝে রাঙামাটি থেকে এসে সরকারী একটি সংস্থা’র প্রতিনিধিরা ঝটিকা অভিযানও চালান তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের টার্গেট করেই।
কিন্তু, কোন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর প্রথম শ্রেণীর দুর্নীতি, কোন ক্ষমতাবানের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদের উৎস কিংবা সরকারী প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মতো ভয়াবহ অপকর্মের তদন্ত-অনুসন্ধানের বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে কখনো কিছু জানার সুযোগ হয়নি।
বেশ ঘটা করে আয়োজিত গণ-শুনানীর ফলাফলও কী হয়, তাও দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং সরকারের এই সংস্থাটির কতিপয় কর্মকর্তাকে খাগড়াছড়িতে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে দৃষ্টিকটুভাবে দহরম-মহরম করতেও দেখা যায়।
সাংবিধানিকভাবে দেশের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী এবং বিশেষ বিবেচনায় কারো কারো কর রেয়াতে গাড়ি আমদানির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের তিন পার্বত্য জেলায় ঠিকাদারি ও সরকারি সরবরাহ ব্যবসাসহ আরো কিছু বিশেষ বাণিজ্যে কর রেয়াতের বিধান চালু আছে। এমনকি এই তিন জেলায় মোট জনসংখ্যার বড়ো একটি অংশ আয়কর অথবা রাজস্ব প্রদান করেন না। এরমধ্যে আয়কর দেয়ার সামর্থ্য রাখেন এবং সে পরিমাণ সহায়-সম্পদের মালিক অথবা সরকারী চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত এমন মানুষের সংখ্যাই সিংহভাগ।
প্রায় সোয়া এক’শ বছরের পুরনো ‘১৯০০ সালের হিলট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল বা উনিশ’শ সালের শাসনবিধি’-এর যৌক্তিকতায় কর না দেয়ার সে সুযোগ তিন পার্বত্য জেলায় এখনো বহাল আছে!
শুধু তাই নয়, তিন পার্বত্য জেলায় কর্মরত পাহাড়িদের মধ্যকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদেরকেও বেতন থেকে আয়কর কাটা হয় না। তবে সমতলে পোস্টিং হলে আয়কর কাটার বিধান চালু রয়েছে।
পার্বত্যাঞ্চলের অনেক দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী আছেন, যাঁদের চাকরি জীবনের পুরোটাই এই তিন পার্বত্য জেলাতেই শেষ হয়েছে। তার মানে তাঁদের কাউকেই কখনো আয়কর দিতে হয়নি। আয়কর হালখাতায় তাঁদের নামও কখনো উঠেনি। ফলে তাঁদের অর্জিত অন্যসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণও সরকারের কোন দপ্তরের জানার সুযোগ হয়নি।
আচ্ছা, এতো গেলো সরকারী কর্মচারীদের কথা।
সরকারী অবকাঠামো উন্নয়নের কথা যদি আসে তাহলে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ ‘কর ফাঁকি’র ঘটনাটি সম্ভবত তিন পার্বত্য জেলাতেই ঘটে চলেছে। এখানে দশ লক্ষ থেকে শত কোটি টাকার উন্নয়ন-সরবরাহ কাজে সরকারীভাবে ‘কর মওকুফ’ প্রথা চালু আছে। ফলে যেকোন অংকের সরকারী উন্নয়ন কাজে চিহ্নিত সেসব লাইসেন্সকেই প্রভাবশালীরা একের পর এক ব্যবহার করছেন।
রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কাজ হাতিয়ে নিয়ে কর মওকুফ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কার্যাদেশ আদায়ের পর দ্বিতীয় পক্ষের কাছে মৌখিক চুক্তিতে কাজ বিক্রি’র মতো ঘটনাও ঘটে চলেছে। ফলে কর না দেয়ার এবং কর ফাঁকি দেয়ার একটি সহজ পন্থা তিন পার্বত্য জেলাতে টিকে আছে বছরের পর বছর।
তিন পার্বত্য জেলায় জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ হজমের আর একটি বড়ো হাতিয়ার হলো অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চল। যেটিকে স্থানীয়ভাবে খাস টিলা-পাহাড় বলেই অভিহিত করা হয়।
শত শত একর পাহাড় নামে-বেনামে জুমিয়া এবং পুর্নবাসিতদের কাছ থেকে তথাকথিত ‘আঞ্চলিক দলিল’-এর বদৌলতে কিনে দখল নেয়া হয়। তারপর সেসব জায়গায় লক্ষ কোটি টাকার বাগান-বাগিচা গড়ে তোলা হয়। কালো টাকা এবং জ্ঞাত আয় বর্হিভূত কাড়ি কাড়ি টাকা সহজেই অঘোষিতভাবে সাদা ধবধবে হয়ে উঠে। আর এজন্য সরকারকেও কিছু জানাতে হয় না আবার সরকারকে এক কানাকড়িও দিতে হয় না।
আবার বিপদ ঘনিয়ে আসলে নির্দ্বিধায় বলা চলে বলা চলে, ‘এসব তো আমার নয়’। এ যেনো সেই মান্ধাতার আমলের আইনের চিচিংফাঁক!
তাই তিন পার্বত্য জেলায় অনির্ধারিত এই ভূমির মালিকানার সুবাদে ঘটে চলা ভয়াবহ আর্থিক জালিয়াতি প্রতিরোধে প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থাও।
সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, নির্বাচনের সময়ও এসব গায়েবী ভূমি এবং বাগান-বাগিচার কোন হিসেব নির্বাচন কমিশনের কাছে হলফনামায় উল্লেখ করতে হয় না।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সম্পাদিত-বিশ্বনন্দিত ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’র পর তিন পার্বত্য জেলাকে এখন আগেকার মতো পশ্চাতপদ এলাকা বলার দিন শেষ হয়ে এসেছে। বিশেষ করে ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারী ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে সমতলের যেকোন জেলার চেয়ে তিন পার্বত্য জেলা এগিয়ে রয়েছে। কোন কোন সময় তা অনেক জেলাকে ছাড়িয়েও যাচ্ছে।
সমতলের মতো এখানেও বৃহদাকার অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এবং এসব প্রকল্পের সাথে কোন না কোনভাবে সরকারী দলের প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততা-অংশীদারিত্ব থাকাটা একেবারেই স্বাভাবিক। যেকোন সরকারের আমলেই সরকারী দলের নেতারাই ফুলে ফেঁপে বড়ো হবেন, এটা এখন আর কোন সংকোচের বিষয় নয়। তবে তাঁরা যদি নিজেরাই কর ফাঁকি দেন বা দেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন, তাহলে অন্যদের কী শোধরাবেন?
দীর্ঘদিন পর দেশে বঙ্গবন্ধু কন্যা- টানা তিনবারের সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি বিরোধী একটি দু:সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেই সাহসী পাকড়াও অভিযানের ঢেউ আঁছড়ে পড়ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও।
চট্টগ্রাম থেকে তিন পার্বত্য জেলার গড় দূরত্ব মাত্র এক’শ কিলোমিটার। তবে ভৌগলিক দূরত্ব যাই হোক, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলে কিছু আইনী বিশেষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে। স্থাবর-অস্থাবর জমির মালিকানার প্রথা, ব্যক্তি সম্পদ ব্যবস্থাপনার ধরন, সরকারী চাকরিজীবি-ঠিকাদারিতে কর মওকুফ ও কর ফাঁকি’র ফাঁকফোঁকড় এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ের পথ প্রশস্ত করার স্বার্থেই সরকারের এখনিই পার্বত্যাঞ্চলে নজর দেয়া উচিত।
একই দেশে একই আলো-হাওয়ায় জনগণের করের টাকায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সামর্থ্যবান নাগরিক, জনপ্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী হয়ে আয়কর না দেয়ার মধ্যে কোন গৌরববোধ অসমীচিন। তারওপর নিজের ঠিকাদারী লাইসেন্স থাকার পরও কর রেয়াতের লাইসেন্স ব্যবহার করার নগ্নতা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রীতিনীতির প্রতি এক ধরনের দৃষ্টতাও বটে।
যেহেতু বিশেষ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত সেহেতু বিশেষ কাঠামোবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সরকারের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে কার্যকর দেখতে চান পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।
প্রয়োজনে তিন পার্বত্য জেলার অবকাঠামো উন্নয়নে নিয়োজিত সবকটি প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ, সরকারী তিনটি বিশেষায়িত জেলা পরিষদ, আবাসিক ভবনের নকশা অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পৌরসভাসমূহ, বাণিজ্যিক ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষগুলোর সমন্বয়ে তিন পার্বত্য জেলার জন্যই একটি বিশেষ দুর্নীতি বিরোধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে সরেজমিনে বড়ো অংকের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবতা, কার্যকারীতা এবং দূর-দর্শিতা সম্পর্কে গণ-শুনানীর আয়োজনও সহজ হবে।
বিশেষ করে, পৌরসভা থেকে ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে নির্মাতা ব্যক্তি’র আয়ের উৎস জানার একটি বাধ্যবাধকতার বিধান সংযুক্ত করে দিলেও তিন পার্বত্য জেলায় জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য জানার একটি পথ বেরিয়ে আসবে।
পার্বত্যাঞ্চলের জন্য বিশেষ ধরনের কাঠামোতে সম্পূর্ন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং স্থানীয় বিজ্ঞ আইনজীবিদের সংযুক্ত করা যেতে পারে। কারণ, এখানে এসব সরকারী-বেসরকারী স্টেকহোল্ডারদের প্রতি সর্বসাধারণের ইতিবাচক মনোভাব এখনো টিকে আছে। আর এতে মানুষ আস্থা আর সাহস নিয়ে নানা মাধ্যমে নিজেদের অভিযোগসমূহ প্রেরণ করতে পারবেন এবং সরকারের চলমান অভিযানে নিজেদের প্রত্যাশাকে যুক্ত করে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশীদার হতে পারবেন। এর মাধ্যমে সরকার সমতলের মতো পার্বত্য তিন জেলা থেকেও দেশের উন্নয়নে আয়ের একটি বড়ো অভ্যন্তরীণ উৎস খুঁজে পাবেন।
প্রদীপ চৌধুরী: সংবাদকর্মী ও নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক।