শনিবার | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

রাঙামাটিতে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে আসছে: মোঃ মোস্তফা কামাল

প্রকাশঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০৫:৫৮:৪১ | আপডেটঃ ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:০০:২৫
“ম্যালেরিয়ায় আর মৃত্যু নয়” - এই কাংখিত লক্ষ্যে এগুচ্ছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি সহ অপর দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা। বাংলাদেশের ম্যালেরিয়া প্রবন ১৩টি জেলার মধ্যে অধিক ঝুকিপূর্ণ জেলা হিসেবে পরিচিত এই তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলার ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান ক্রমন্বয়ে নিম্মমুখী হচ্ছে। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রনে এই সফলতা সকলের মাঝে আশার আলো প্রজ্বলিত করেছে।’
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার সত্তর,আশি ও নব্বই এর দশকের পুরোটা সময় এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক জুড়ে সারা দেশে ম্যালেরিয়া রোগের মৃত্যুপুরী হিসাবে পরিচিত ছিল। এই সময় এখানে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক লোকজন ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হতো এবং শত শত ম্যালেরিয়া রোগী মৃত্যুবরণ করতো। সরকারী চাকুরীজীবিদের জন্য এই তিন পার্বত্য জেলায় বদলী ছিল আতংকের বিষয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ ৫ বছরেই পুরো দেশে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ এর অধিক ছিল তিন পার্বত্য জেলায়।
তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রন সহ ম্যালেরিয়া এবং ১৩টি জেলায় এই রোগ নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট,এইডস, টিবি এন্ড ম্যালেরিয়া ( এ≠অঞগ)  সমন্বয়ে গঠিত কনসোটিয়াম এর অধীনে গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তায় ২০০৭ সালে যে কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় মূলত সেই কর্মসূচীর পর হতে রাঙামাটি সহ তিন পার্বত্য জেলার ম্যালেরিয়া রোগের প্রার্দুভাব ধীরে ধীরে কমে আসে।

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রনে সর্বাধিক এগিয়ে রয়েছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। গত ৫ বছরের ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যানগত দিক পর্যালোচনা করে রাঙামাটির এই সফলতার চিত্র উঠে আসে। বিশেষ করে এই সময়ে এই জেলায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয় মাত্র ৩ জনের। ২০১৮ সালের জুলাই নাগাদ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত কোন রোগীর মৃত্যু হয়নি। অথচ ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৯৮ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ব্র্যাক সূত্রে জানা গেছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির ১০ টি উপজেলার মধ্যে সীমান্তবর্ত্তী ৪টি দুর্গম উপজেলায় ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা সব চাইতে বেশী। জেলার মোট ম্যালেরিয়া রোগীর শতকরা ৬০ ভাগের অধিক এই ৪ উপজেলায়।

স্বাস্থ্য বিভাগ সুত্রে জানা গেছে জেলার ম্যালেরিয়া প্রবন ৪টি উপজেলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ব্র্যাক যৌথ ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে বিশেষ কর্মসূচী পালন করে। বর্তমানে এই ৪টি উপজেলাতেই ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কমে এসেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পার্বত্য রাঙামাটিতে ২০১৪ সালে ১৭১৬৬ জন, ২০১৫ সালে ১৩৮৩৩৩ জন, ২০১৬ সালে ৯৬২৪ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ছিল। ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত এই সংখ্য ছিল মাত্র ১৬৯২জন। পাশাপাশি সিবিআর ( মারত্রিক ম্যালেরিয়ায়) আক্রান্তর সংখ্যাও এই সময় দ্রুত কমে আসে। ২০১৪ সালে ১০৬৩ জন, ২০১৫ সালে ১০২৩ জন এবং ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৭০ জনে, ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৩০ জনে এবং ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ জন। এর আগে সিবিআর ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত মানেই ছিল মৃত্যুে দৌড় গোড়ায় পৌছে যাওয়া। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি সম্পূর্নরূপে পাল্টে গেছে।
ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির এই সফলতার বিষয়ে রাঙামাটি জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ ¯েœহ কুমার চাকমা জানান এটি একটি সমন্বিত উদ্যোগের ফসল। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের একার পক্ষে দূর্গম এই পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব ছিল না। গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তার পাশাপাশি ব্র্যাক সহ অন্যান্য বেসরকারী সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ। প্রত্যন্ত এলাকায় ম্যালেরিয়া রোগ নিরুপনের সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া বিষয়ে জনসচেতনা সৃষ্টি সব কিছুর সুফল হচ্ছে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রনে চলমান অগ্রগতি।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ সুপ্রিয় বড়–য়াও রাঙামাটি পার্বত্য জেলার ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রনে এই সফলতাকে রাঙ্গামাটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য একটি বিশাল অর্জন হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন অন্যান্য রোগ বিশেষ করে যক্ষা, কুষ্টর মতোর রোগ গুলোও নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে হবে। যদিওবা এই ক্ষেত্রে অনেক সফলতা এসেছে।

এ বিষয়ে রাঙামাটি জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ শহীদ তালুকদার বলেন, পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির জেলা সদর থেকে শুরু করে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ম্যালেরিয়া রোগ নিরুপন ও চিকিৎসার বিশেষ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশপাশি মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মী এবং ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরাও তৃণমূল পর্যায়ে ম্যালেরিয়া রোগ নিরুপন এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে। ফলে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওযার সাথে সাথে রোগীরা চিকিৎসা সেবার আওতায় আসছে। রোগ নিরুপন হতে শুরু করে চিকিৎসার যাবতীয় ঔষধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রনে সফলতার বিষয়ে ব্র্যাক রাঙামাটি জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ কেতী চাকমা এবং ব্যবস্থাপক এস.এ. জানান : স্বাস্থ্য বিবাগের নির্দেশনাকে অনুসরণ করে স্বাস্থ্য বিভাগের ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করেছে ব্র্যাক। ব্র্যাকের ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মীরা আরপিডি মেথডে তাৎক্ষণিক ভাবে ম্যালেরিয়া রোগ নিরুপন করে পজিটিভ রোগীদের নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করেন। রোগী যাতে যথাসময়ে সম্পূর্ন চিকিৎসা পায় সে দিকে আমরা সমন্বয় সাধন করি। তাছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে ও ব্র্যাক নিজস্ব ল্যাব এবং ভ্রাম্যমান ম্যালেরিয়া ল্যাব পালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সহায়তায় ইতিমধ্যে জেলার কয়েক লক্ষ ম্যালেরিয়া প্রতিশেধক কীট নাশকে চুবানো মশারী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে। লোকজন এইসব মশারী ব্যবহার করছে বিধায় মশার আক্রমন থেকে রক্ষা পাচ্ছে।

ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রনে এই সফরতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে সবাই সজাগ থাকার আহবান জানিয়েছেন জেলার ম্যালেরিয়া প্রাক্তন ও বর্তমান চিকিৎসক বৃন্দ। তাদের মতে যেহেতু এই রোগ মশার মাধ্যমে ছড়ায় সেহেতু রোগের বাহক ম্যালেরিয়ার এনোফেলিস মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মশারী ব্যবহারের পাশাপাশি বাড়ী এবং আশেপাশের পরিবেশকে নোংরা এবং আর্বজনা মুক্ত রাখতে হবে। আগামী ম্যালেরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রনে বর্তমানে যেসব স্বাস্থ্য কর্মসূচী রয়েছে তাও অব্যাহত রাখতে হবে।


লেখক: মোস্তফা কামাল, সিনিয়র সাংবাদিক, রাঙামাটি


মুক্তমত |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions