রামগড়ে দিনে-দুপুরে পাহাড় ও টপসয়েল কাটছে প্রভাবশালীরা, প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

প্রকাশঃ ১৫ জানুয়ারী, ২০২১ ০৪:৪২:০৩ | আপডেটঃ ২৯ মার্চ, ২০২৪ ০৪:৩৭:৪৩
সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। প্রশাসনের পূর্বানুমতি ব্যতিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়ে অবাদে পাহাড় ও কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল। দিনে-দুপুরে পাহাড় কেটে ও কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে গাড়িতে করে অন্যত্র নিয়ে বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংষ্কার এবং ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করলেও উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। দিনের আলোয় পাহাড় কাটার মহোৎসব চললেও প্রশাসন কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ কর্মীরাও।

পরিবেশ আইন অনুযায়ী কৃষিজমি ও টিলার মাটি কাটা দন্ডনীয় অপরাধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১২–এর ৬ ধারায়) অনুযায়ী, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট টিলা ও পাহাড় নিধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। দুই আইনে শাস্তির বিধান একই রকম। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকার জরিমানা ও দুই বছরের কারাদন্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। একই কাজ দ্বিতীয়বার করলে দায়ী ব্যক্তির ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও ১০ বছরের কারাদন্ড হবে। এ ক্ষেত্রে এ কাজের সঙ্গে জড়িত জমি ও ইটভাটার মালিক উভয়ের জন্যই সমান শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণহানী ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। বিনা বাধায় পাহাড় খেকোরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষা আইনের লঙ্ঘন করে খাগড়াছড়ির রামগড়েউপজেলার সোনাইআগা, কালাডেবা, খাগড়াবিল, বলিপাড়া, সদুকার্বারী পাড়া, বল্টুরাম টিলাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে স্কেভেটর ব্যবহার করে অবাদে পাহাড় ও কৃষি জমির টপসয়েল কেটে ট্রাকে করে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে পাহাড় খেকোরা। কাটার আগে এসব পাহাড় ও কৃষি জমি স্বল্প দামে ক্রয় করে মাটি কেটে তা চড়া দামে বিক্রি করছে তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার অন্তত ৫-৭টি স্থানে অবাদে এসব পাহাড় ও জমির টপ সয়েল কাটা সিন্ডিকেটে জড়িত আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ছাড়াও একই দলের নির্বাচিত বর্তমান জনপ্রতিনিধি, সাবেক জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত রয়েছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাগড়াবিল জুনিয়র হাই স্কুলের পাশের পাহাড়, বল্টুরাম টিলা এনআরডিসি সমিতি ভবনের পাশের পাহাড় ও সোনাইআগাসহ উল্লেখিত স্থানে ‘বুলোডোজার দিয়ে পুরোটা পাহাড়ে উপরিভাগ কয়েকটি লেয়ারে কাটা হয়েছে। পাহাড়ে কোথাও সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই। পাহাড়ের কাটা মাটি পড়ে আশপাশের জলাশয়ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক লক্ষ ঘণফুট মাটি কাটা হয়েছে এসব স্থান থেকে। নতুন করে আরো এক লেয়ারে অর্ধেক কাটার কাজ শেষ। এসব মাটি বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়।’এর বাইরে উঁচু কিছু কৃষি জমিকে ফলন উপযোগী করার অজুহাতে স্কেভেটর দিয়ে জমির উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল) কেটে ট্রাক্টর ও পিক-আপে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উপজেলার বেশ কয়েকটি অবৈধ ইটভাটায়। এসব মাটি নিয়ে যেতে দিনে-দুপুরে খাগড়াবিল, কালাডেবা হয়ে সোনাইপুল ও রামগড়ের প্রধান সড়ক ব্যবহার করা হলেও অদৃশ্য কারণে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায় নিরব। পাশ্ববর্তী গুইমারা, মানিকছড়ি ও মাটিরাঙ্গা উপজেলায় নিয়মিত পাহাড়খেকো ও ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা ও দন্ড প্রদান করা হলেও রামগড়ে ঘটছে তার ঠিক উল্টো। গত কয়েকমানে উপজেলার কোথাও দৃশ্যমান অভিযানও পরিচালনা করেনি উপজেলা প্রশাসন।

এছাড়া বিভিন্ন ড্রাম ট্রঠশ ও ট্রাক্টরে নিয়মিত মাটি পরিবহণ করায় খাগড়াছড়িল, কালাডেবাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার গ্রামীন সড়কগুলোতেও ব্যাপক ক্ষতিসাধান হয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা বিষয়টি নিয়ে অতিষ্ট হলেও প্রভাবশালীদের দাপটের কাছে অসহায়, যার ফলে ভয়ে মুখ খুলতে চাইছে না কেউই।

স্থানীয়রা জানান , ‘কম দামে পাহাড় কেটে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা পাহাড়ে থাকা গাছের গাছপালা কেটে মাটি বিক্রি শুরু করেছে। সকাল থেকেই বুলডোজার দিয়ে এখানে মাটি কাটা হয়। দিনেই পরিবহন করে। ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ  তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে না। তবে কয়েকজন জানান পাহাড় কাটা ক্ষতি । কিন্তু আমরা কিছু বললে এলাকায় থাকতে পারব না।’

নির্বিচারে পাহাড় ও কৃষি জমির টপ সয়েল কাটায় স্থানীয় এক ব্যক্তি এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে, খাগড়াছড়ির গুইমারা, মাটিরাঙ্গাসহ কয়েকটি উপজেলায় অবৈধ ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করে দন্ড, জরিমানাসহ ভাটা গুড়িয়ে দিচ্ছে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন। অদৃশ্য কোন কারনে রামগড়ের ভাটাগুলো যেন দ্বিগুন শক্তি নিয়ে জ্বলে উঠেছে।
এখানে উপজেলা কিংবা জেলা প্রশাসন নিরব, পরিবেশ অধিদপ্তরতো রামগড় চিনেই না। সবচেয়ে বড় কথা হলো রামগড়ে সব ইটভাটার মালিকই কোন না কোন জাতীয় রাজনৈতিক দলের হেডামধারী নেতা। বিএনপির এক নেতা এমনকি বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানও এখানে কৃষি জমি ধ্বংস করে ভাটা চালাচ্ছেন, পোড়ানো হচ্ছে বনের চারা গাছ, কাটা হচ্ছে জমির টপ সয়েল, পাহাড়ের মাটি। আর দোহাই দেয়া হচ্ছে উন্নয়নের। আইন যেন প্রভাবশালী এসব নেতাদের পকেটের খুচরো পয়সা।’

খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী জানান ‘অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ষায় পার্বত্য জেলায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। প্রশাসনিক ভাবে পাহাড় কাটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দেদারছে পাহাড় কাটা চলছে। অবিলম্বে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করা না গেলে ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড় কাটা সিন্ডিকেটের একজন কাজী সেলিম পাহাড় কাটার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন ‘আমি ঠিকাদির কাজ করি। পাহাড় কাটা আমার কাজ নয়। এছাড়া রামগড় উপজেলার কোথাও আমি পাহাড় বা টপ সয়েল কাটি এটার কেউ প্রমান দিতে পারবে না বলেও জানান তিনি।’

পাহাড় ও টপ সয়েল কাটা চক্রের অন্য আরেক সদস্য ও পৌর আওয়ামীলীগের এক নেতাকে এ বিষয়ে জানতে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে জানতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মু. উল্লাহ মারুফকে মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি, তবে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) সজীব কান্তি রুদ্র মুঠোফোনে পাহাড় ও টপ সয়েল কাটার বিষয়টি নিয়ে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানান। দিনে-দুপুরে পাহাড় কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, দিনের বেলা পাহাড় কাটার বিষয়ে তার জানা নেই। তিনি আরো বলেন, অভিযান পরিচালনা করতে গেলে ঘটনাস্থলে কাউকে পাওয়া যায়না।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ জানুয়ারি একই চক্র কর্তৃক উপজেলার ১ নম্বর রামগড় ইউনিয়নের খাগড়াবিল জুনিয়র স্কুলের পাশের একটি পাহাড় কেটে মাটি ড্রাম ট্রাকে লোড করার সময় হঠাৎ পাহাড় থেকে মাটির একটি বড় অংশ ধসে পড়ে সেখানে কর্মরত দুই শ্রমিকের উপর। এসময় জেলার মাটিরাঙ্গার তৈকাতাং হেডম্যান পাড়ার খেরত কুমার ত্রিপুরার ছেলে এতে খগেন্দ্র ত্রিপুরা (৩৫) মাটির নিচে সম্পূর্ণ চাপা পড়ে নিহত হন এবং একই এলাকার হেতেন্ত্র ত্রিপুরার দেহের অর্ধাংশ চাপা পড়ে তিনিও মারাত্বক আহত হন। এরপরও অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়নি সেখানে পাহাড় কাটার মহোৎসব।