প্রকাশঃ ২৭ জুলাই, ২০২০ ১০:১১:১৪
| আপডেটঃ ০৮ অক্টোবর, ২০২৪ ১০:১০:০৩
একদিকে সাংবাদিকতা পেশা। অন্যদিকে মার্চের শুরু থেকে করোনা রোগী ছাড়াও মানুষদের করোনা সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করে যাচ্ছিলাম। তাই যেকোন সময় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হব মনে এ চিন্তা ছিল। হলে এটি মোকাবেলা করার মানসিকতাও ছিল।
এমন অবস্থায় গত ১৪ জুলাই জ্বরে আক্রান্ত হলাম। জ্বর, কাশি, শরীর ব্যথা নিয়ে ১৫ জুলাই রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে নমুনা দিলাম। ১৭ জুলাই রিপোর্ট পজেটিভ আসে।
সেদিনই শহরের চম্পক নগরে আঞ্চলিক জনসংখ্যা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হোস্টেলে আইসোলেশনে ভর্তি হই। ভর্তি হবার পর পর ডান হাতে ক্যানোলা লাগানো হল। শুরু হল ইনজেকশন। শুরু হল নতুন যুদ্ধ। শুরু হল ১৪ দিনের বন্ধি জীবন।
মনে হল, আইসোলেশনের চার দেওয়ালের ভিতরে ডাক্তার, নার্স ওয়ার্ড সহকারী ছাড়া বাকীরা সবাই পর। স্বাভাবিক মানুষ কেউ আসতে চায় না আমাদের আশেপাশে। বিশেষ কোন কারণে কাউকে আসতে হলে ফটক থেকে দ্রুত চলে যায়।
মনে হয়, এ বিচ্ছিন্ন চার দেওয়ালের ইটের ঘরটি আমাদের বন্ধিশালা। নিচে নামতে পারি না। জেলখানায় তো স্বজনরা দেখা করতে যায় আর আমাদের বন্দিশালায় কোন স্বজনকে কাছে পাওয়া যায় না।
ক্যানোলায় দিয়ে দৈনিক দুবার ইনজেকশন দেয়া হয়। শরীরে ইনজেকশন দিলে মনে হয় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি। তৃতীয় দিনের মাথায় আমার ক্যানোলা খুলে দেওয়া হয়। তখনই পুরোপুরি সুস্থ আমি। অর্থাৎ ১৪ দিনের আগে আমি পুরোপুরি সুস্থ।
এ সময়ে আমি ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড সহকারীদের সেবা দেখে তাদের প্রেমে পড়েছি। তাঁদের হাসিখুশি সেবা বার বার আমাকে মুগ্ধ করে। তাঁরা মানুষ নয়, তাঁরা যেন প্রকৃত আল্লাহ, ভগবান।
যাদের কথা বলতে হয়, ডাক্তার সাজ্জাদ, ডাক্তার আশরাফ, নার্স শ্যামলী, সাধনা, মিঠু তালুকদার, শুভ্রা রানী বড়–য়া, হেলেনু মারমা, ওয়ার্ড সহকারী তুর্জ, অলক দেওয়ান, স্বপন। তাঁদের সুন্দর সমন্বয়। এ যেন একটি সুখী পরিবার। সারাক্ষণ একে অপরের ডাকাডাকি।
রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি রোগীদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেন সবসময়। নিজেরাও হাসিখুশিতে থাকার চেষ্টার কমতি নেই।
ডিউটি শেষে গিটার দিয়ে গান ধরেন ব্রাদার মিঠু তালুকদার। গিটার আর গানের সাথে সুর ধরেন সিস্টার সাধনা চাকমা। তাঁর সাথে গান ধরেন সিস্টার শুভ্রা রাণী বড়–য়া। কখনো সাউন্ড বক্সে সুমধুর গান। নিরব আইসোলেশ সেন্টার গানের সুরে সরগরম হয়ে উঠে। আনন্দহীন মনে প্রাণ ফিরে আসে সবার মাঝে।
বিনোদন শেষে পিপিই পড়ে রাউন্ডে নামেন ব্রাদার সিস্টাররা।রাউন্ড শেষ হবার পর আবারো গিটার হাতে নেন মিঠু। শুরু হয় বিনোদন পর্ব।
সেবা কেন্দ্রের পরিবেশ: রাঙামাটি শহরের চম্পক নগরে আঞ্চলিক জনসংখ্যা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হোস্টেল। এর চারিদিকে বড় বড় সবুজ বৃক্ষ। সেবা কেন্দ্রের মাঝে ফল বৃক্ষ। মন চাইলে পাকা কাঠাল, ভিটামিন সি সম্মৃদ্ধ ফল আমড়া পেরে খাওয়া যায়।
আমরা হাসপাতালে সাধারণত দেখি দীর্ঘ সারির বেড। প্রতিটি বেডে রোগী থাকে। কিন্তু রাঙামাটির আইসোলেশন সেন্টারটি এমন নয়।
প্রতিটি রোগীর জন্য একটি করে রুম। প্রতিটি রুমে তিনজন থাকার ব্যবস্থা থাকলেও রাখা হয় মাত্র একজন। একই পরিবারের তিনজন হলে একেবারে যথার্থ। বন্ধু বা সমমনা হলে একটি রুমে থাকা যাবে আনন্দে।
গড়া যাবে সুন্দর একটি পরিবার। প্রতিটি রুমে রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। প্রয়োজন নিজস্ব খরচে একটি লম্বা তারের মাল্টিপ্লাগ। যেটা দিয়ে ইলেক্ট্রিক কেটলি দিয়ে পানি গরম করা, মোবাইল চার্জ দেওয়া যায়।
নিচে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে। ওয়ার্ড সহকারীদের বললে তারা খুশি মনে পানির বোতল পুর্ণ করে দিয়ে রুমে এসে দিয়ে যায়।
দিন কাটে যেভাবে: একদিন অতিবাহিত করা যেন এক যুগ অতিক্রম করা। ভোর হতেই ওয়ার্ড সহকারীরা ডাস্টবিন পরিষ্কার করে। পুরো সেন্টারে ব্লিচিং পানি ছিটাই। এরপর তারা নাস্তা আনে ভাগ করে দেয়। এর পর নার্সরা রাউন্ডে আসে। তারা চলে যাবার পর আজ কাজ থাকে না। দুপুর দেড় টায় দুপুরের খাবারের প্যাকেট আসে। ওয়ার্ড সহকারী এগুলো বিতরণ করে। সকালে বা বিকালে আইসোলেশন সেন্টারে হাটাহাটি বা ব্যায়ামের সুযোগ আছে। সন্ধ্যায় আবার রাউন্ডে আসে ব্রাদার সিস্টাররা। রাতে খাবার বিতরণ শেষ হলে নীরব হয়ে যায় আইসোলেশন সেন্টার।
যে খাবার দেওয়া হয়:সকালে নাস্তায় দুটো বাটার বন, দু পিস কলা, এ গ্লাস দুধ, একটি ডিম। দুপুরে ভাতের সাথে সবজি, ডাল, মাছ অথবা মুরগীর মাংস অথবা ছাগলের মাংস। এসব মাছ মাংস হল পালাক্রমে।
করোনা রোগীদের ভালোবাসুন:
করোনা রোগীদের কাছে গিয়ে ডাক্তার নার্সরা যেভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সেটা ভাষায় বলে প্রকাশ করার মত নয়। আক্রান্ত হলে তাদের আগের হওয়ার কথা। কিন্তু তারা সুস্থ থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারাও তো মানুষ। কিন্তু অন্য মানুষরা কেন এত করোনা রোগীকে ভয় পায়। ভয় না পেয়ে স্বাস্থ্য বিধিগুলো মেনে চললে বেশ। রোগীর কাছে গেলে মুখে মাস্ক দেওয়া। পিপিই পড়া। সতর্কতা অবলম্বন করা। করোনা নিয়ে মানুষের মাঝে যে ভয় ঢুকানো হয়েছে এ ভয় দুর করতে হবে সবার মাঝে। করোনা চিকিৎসায় ভাল হয়। এটি মরণ ব্যাধি নয়। শরীর থেকে জ্বর কমে গেলে একপ্রকার করোনা জয় হয়। কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হন তাহলে শরীরে কি কি অসুবিধা হচ্ছে তা বিস্তারিত ডাক্তারকে খুলে বলুন। মনে রাখতে হবে উপসর্গ ভিত্তি করে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেজন্য কোন কিছু লুকানো যাবে না।
যে শূণ্যটা অনুভব করেছি: আইসোলেশন সেন্টারে দিন কাটানো একদিন যেন একযুগের মত। দিনভর সময় কাটানোর জন্য প্রয়োজন ইন্টারনেট সেবা। কিন্তু সেখানে ইন্টারনেট ব্যবস্থা দুর্বল। কোন কোন রুমে নেটই পাওয়া যায় না। বর্তমানে অনেক দ্রুতগতির ইন্টার নেট কম টাকায় পাওয়া যায়। সেখানে যদি একটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যায় সবাই উপকৃত হবে। তখন ইন্টারনেটে বসে সময় কাটানো সহজ হবে।
আইসোলেশন থেকে বের হয়ে অনুভুতি: যখন আইসোলেশন থেকে বের হলাম যেন মুক্তি পেয়েছি। বার বার তাকিয়ে দেখছিলাম আইসোলেশন সেন্টারটি। সেখান থেকে যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে অটোরিকশা যোগে রওনা দিলাম দিয়ে রাস্তায় যখন মানুষ দেখতে পেলাম খুশিতে মন ভরে গেল। মানুষ দেখতে দেখতে অভ্যস্থ সেখানে এতদিন মানুষ না দেখে বদ্ধ ঘরে ছিলাম তাই অনুভুতি ছিল অন্য রকম।
যাদের কাছে কৃতজ্ঞ:আমার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট পাবার পর থেকে আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা করায় আমি ডা: বিনোদ শেখর চাকমা, রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শওকত আকবর খান, সিভিল সার্জন কার্যালয়ে করোনা ফোকাল পার্সন ডা. মোস্তফা কামালের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। আমাকে সেবা দিতে তাদের অবস্থান থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।
আমি আইসোলেশনে চলে যাবার পর আমার পুরো পরিবারের চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব নেওয়ায় ডা. বিনোদ শেখরের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক একে এম মামুনুর রশীদ, এনডিসি উত্তম কুমার দাশ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাপস রঞ্জন ঘোষ, সাবেক রাঙামাটি সিভিল সার্জন ডা.শহীদ তালুকদার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিয়েছেন। সাংবাদিক ফজলুর রহমান রাজন ভাই ঔষধ এনে দেওয়াসহ সব সময় পাশে ছিলেন।
এছাড়া আমাকে খাদ্যসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করায় জুরাছড়ি শিক্ষা অফিসার কৌশিক চাকমা, ভাবী তন্দ্রা চাকমা, প্রথম আলো সাংবাদিক সাধন বিকাশ চাকমা, রাজবাড়ির যশেশ্বর চাকমা (বিল্টু), বনরূপা বিশিষ্ট সমাজ সেবক স্নেহাশীষ চাকমা, শিক্ষক খুশী চাকমা, আমাদের ক্যামেরা পার্সন রাজীব দাশ মুন্নার নিকট আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।