সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। আজও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি রাঙামাটির পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের। চলতি বছর ১৩ জুন ভয়াল এ পাহাড় ধসের দুর্যোগ ঘটে। কেবল রাঙামাটি নয় সারাদেশের বছরের সবচেয়ে আলোচনাবহুল এবং মর্মস্পর্শী ঘটনা এটি। দুর্যোগে ৫ সেনা সদস্যসহ জেলায় ১২০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। বিস্তর রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন স্থাপনাসহ ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক- যা গত ৬ মাসেও পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্তরা। পুনর্বাসন ছাড়াই ফের ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় গিয়ে বাস করতে হচ্ছে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে।
খোঁজ নিয়ে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে দীর্ঘদিন দুর্বিষহ জীবন কেটেছে ক্ষতিগ্রস্তদের। সেই অবস্থায় প্রায় তিন মাসের মাথায় ৭ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেয়া হয় আশ্রয় কেন্দ্র। এদিকে তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এবং উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা শুরু করে জেলা প্রশাসন। এগিয়ে সরকার এবং দেশী বিদেশী বিভিন্ন মহল। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসে সার্বিক পরিস্থিতি। শহরসহ জেলার আশেপাশে এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় সরকারিভাবে ১৯ আশ্রয় কেন্দ্র খোলে জেলা প্রশাসন। এসব আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনায় সহায়তা করে সেনাবাহিনী, পুলিশ, রাঙ্গামাটি পৌরসভা, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংস্থা। ৭ সেপ্টেম্বর আশ্রয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়ার পর যার যার চেষ্টায় মাথাগোঁজার ঠাঁই নেন আশ্রিতরা। বেশিরভাগ লোকজনের কোথাও যাওয়ার ঠাঁইটুকু ছিল না। কেউ গেছেন নিজেদের আত্মীয় আশ্রয়ে, কেউ ভাড়া বাসায় আবার অনেকে গেছেন বিধ্বস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায়। সরেজমিন তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় লোকজন এখনও দুঃসহ মানবেতর দিনযাপন করছেন। অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় গিয়ে নতুন বসতি নির্মাণ বা বিধ্বস্ত বাড়িঘর মেরামত করে বাস করলেও দুর্ভোগ শেষ হয়নি তাদের।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়ে সরকারিভাবে খোলা আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ৭ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেয়া হয়। এসব কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্বজন ও বাড়িঘর হারা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। বিদায় বেলা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ৬ হাজার টাকা, ২ বান্ডেল ঢেউ টিন, ৩০ কেজি চাল এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ১ হাজার টাকা ও ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়। এছাড়া স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) গ্রিণহিল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের আর্থিক দিয়েছে। পরে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) হতে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে নগদ ১৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান বলেন, পুনর্বাসন কার্যক্রম একেবারে থেমে যায়নি। আশ্রয় কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়ার সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলেও যাতে বিধ্বস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় গিয়ে বাস করতে না হয় সেজন্য ক্ষতিগ্রস্তদের এক জায়গায় বাড়িঘর করে দিয়ে পুনর্বাসন করার চিন্তা ছিল। এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়েছিল। এ ছাড়া দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পক্ষেও পুনর্বাসনে এগিয়ে আসার প্রস্তাব পাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড় ধসের পরপরই বন্যায় ক্ষত্রিগ্রস্ত এবং রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা ইস্যুতে রাঙামাটির পাহাড় ধসে ক্ষত্রিগস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ মানুষের নিজস্ব জমি নেই। যাদের ছিল তাদের বেশিরভাগ মানুষের ভিটামাটি বিধ্বস্ত ও বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বাস্তব পরিস্থিতির কারণে অনেকে নিজেদের বিধ্বস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় গিয়ে বাস করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি তাদেরকে কিছুই বলারও নেই।
জেলা প্রশাসক বলেন, যদি সুযোগ হয় এক জায়গায় বাড়িঘর করে দিয়ে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের অবশ্যই পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হবে। এজন্য জায়গা নির্বাচনের প্রস্তাবও রয়েছে।
তিনি জানান, ১৩ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় শহরসহ জেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ১২৩১ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ হাজার ৫৩৭। জেলায় এসব ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সর্বশেষ ৭৭৬ টন চাল, নদগ ১ কোটি ৬৫ লাখ ৮৬ হাজার, ৭০০ বান্ডেল ঢেউ টিন এবং গৃহ নির্মাণ ব্যয় মঞ্জুরি বাবদ ১৫ লাখ টাকাসহ বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রি বিতরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১২০ জনের- যাদের মধ্যে ছিলেন ৫ সেনা সদস্য। এছাড়া রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান সড়কসহ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রাস্তা, স্থাপনা, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়ার পর শহরের ভেদভেদীর পশ্চিম মুসলিম পাড়া, সনাতন মন্দির এলাকা, যুব উন্নয়ন অফিস সংলগ্ন এলাকা, শিমুলতলী, রেডিও স্টেশন সংলগ্ন এলাকা, রূপনগরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিধ্বস্ত ভিটায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত বা নতুন বসতি নির্মাণ করে বাস করছেন ক্ষত্রিগস্ত অনেকে। তারা বলেন, সরকারের তরফ থেকে আমাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়া হলেও তা আজ একেবোরে ভেস্তে গেছে। যাওয়ার তো আর কোথাও নেই। তাই ঝুঁকিতে হলেও এভাবে বাস করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই। আজও দুঃসহ বেদনায় মানবেতর জীবন পার করছি আমরা।
শহরের রূপনগর এলাকা গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়ার পর মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু করে নিয়েছেন পরিত্যক্ত স্থাপনা এবং আশেপাশের আত্মীয় বাড়ি ও ভাড়া বাসায়।
এ প্রতিবেদক কথা বলেন রমিজের স্ত্রী নার্গিস (৩০), চান মিয়ার স্ত্রী খুরশিদা বেগম (৩০) ও কামরুলের স্ত্রী পারভীনের (২৯) সঙ্গে। তারা বলেন, তাদের ভিটাবাড়ি ছিল রূপনগরে। ১৩ জুনের পাহাড় ধসের ঘটনায় মাটির নিচে বিলীন হয়ে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে দীর্ঘ আড়াই মাস ছিলেন আশ্রয় কেন্দ্রে। আশ্রয় কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ায় যেতে হয়েছে পরিত্যক্ত স্থাপনায় ঠাঁই করে। আবার কেউ কেউ কষ্টে হলেও ভাড়া বাসায়। দুই বান্ডেল করে ঢেউটিন দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিধ্বস্ত ভিটায় নতুন করে ঘর বানানোর কোনো সুযোগ নেই। টিনগুলি আজও ফেলে রেখেছি।
এদিকে দেখা যায়, সদরের রেডিও সেন্টারের আশেপাশে কেউ কেউ ঝুঁকিপূর্ণ ভিটায় ফিরে বাস করছেন বাড়িঘর মেরামত করে। ত্রাণের ঢেউ টিন দিয়ে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামত করেছেন বলে জানিয়েছেন তারা।