প্রকাশঃ ২৬ মে, ২০২০ ০৩:২৫:৪৩
| আপডেটঃ ০৫ অক্টোবর, ২০২৪ ০২:৪১:০৫
ষ্টাফ রিপোর্টার,রাঙামাটি। প্রতি বছরের মত পাহাড় পুড়িয়ে জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে পাহাড়ের জুম চাষীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সনাতন পদ্ধতিতে পাহাড়ীরা জীবিকা নির্বাহে যুগ যুগ ধরে জুম চাষ করে আসছে। জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের খাদ্যের সংস্থান করে থাকেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ী এলাকায় উপজেলা জুড়ে প্রতিবছরের ন্যায় জুমিয়ারা এবারও বন-জঙ্গল কেটে পাহাড়ী ভূমি জুম চাষের উপযোগী করে নিয়েছে। জেলার শত শত একর পাহাড়ী ভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে আগুন দিয়ে গাছ পালা পুড়িয়ে জুম চাষের উপযোগী করা হচ্ছে।
ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সমূহের লোকজন জানান, প্রতিবছর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে জুমিয়ারা জুমের জন্য বাছাই করা পাহাড়ের বন-জঙ্গল কাটেন। মার্চ-এপ্রিল এবং মে মাসের দিকে জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ী ভূমিতে বীজ বুননের উপযোগী করতে পাহাড়ে আগুন দেয়। আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে মে -জুনের শুরুতে বীজ বুনন শুরু করেন। সেপ্টেম্বর অক্টোবরে ফলন কাটে। জুমে পাহাড়ী ধানের পাশাপাশি মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, কুমড়া, ভুট্টা, যব, মারফা (পাহাড়ী শশা), ছিনারগুলা (পাহাড়ী মিষ্টিফল), তুলা, টকপাতাসহ রকমারী কৃষিপণ্যের চাষ করে থাকেন।
প্রসঙ্গত: জুমিয়া পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে পাহাড়ের একই জায়গায় বার বার জুম চাষ করে না। অন্তত: দুই/তিন বছর বিরতি দিয়ে পুনরায় ওইসব জায়গায় জুম চাষ করেন। প্রতিবছর নতুন নতুন পাহাড় খুঁজে জুম চাষের জন্য পাহাড় কাটা হয়। তাদের ঐতিহ্যের ধারায় জুম চাষের ফলে পাহাড়ের বন-জঙ্গল ক্ষতি হলেও জুমিয়া পরিবারগুলোকে বিকল্প পেশা তৈরীতে সরকারী-বেসরকারী কোন উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
কৃষি বিভাগের মতে, রাঙামাটিতে এবার ৬ হাজার হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হবে, গত বছর জুম চাষ হয়েছিল ৫ হাজার ৯শ হেক্টর জমিতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ৪০ হাজার পরিবার এখনো জুম চাষ নির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে প্রায় ১৪হাজার, রাঙামাটিতে প্রায় ১২হাজার ও বান্দরবাসে প্রায় ১৪হাজার জুমিয়া (জুমচাষী) রয়েছে।
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের(এডিবি) এক জরিপে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে শতকরা ৭০ শতাংশ জুম চাষের উপর নির্ভশীল। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী প্রাচীন কাল থেকে সনাতন পদ্ধতিতে জুম চাষ করে আসছে। আদিবাসীদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে এডিবি জুম চাষের পরিবর্তে তাদেরকে অন্য পেশায় উৎসাহিত করার একটি প্রকল্প নিলেও তা সফল হয়নি।
প্রতি বছরের মত এবছর জুম চাষীরা পাহাড়ে আগুন দিয়েছে, বাঘাইছড়ি সাজেক এর শত শত একর বিস্তীর্ণ বনভুমিতে আগুন দেয়া হয় জুম চাষের উপযোগী করতে। পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রভাবে বিগত কয়েক বছর তুলনামুলক জুম চাষ কম হয়েছে সাজেকে, এবার লকডাউন আর রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় জুমিয়ারা অবাধে পাহাড় পোড়াচ্ছেন বলে এমন অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা জানান, পাহাড়ীরা জুম চাষের উপর নির্ভর,, সারা বছরের খোরাকি আসে জুম চাষ থেকে। তাই জুমিয়ারা এসময়ে পাহাড়ে আগুন দেয়, সরকার যদি বিকল্প ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে কৃষকরা জুম চাষ করবে না।
বাঘাইছড়ির সাজেকে পাহাড়ে আগুন দেয়ার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব জিতু বলেন, গত মাসের শেষের দিকে আমি সাজেক যাওয়ার পথে দেখেছি বিস্তীর্ণ পাহাড়ে আগুনে দিতে, আবার এই সপ্তাহ গেলার তখন আগুন ছিলো না, পাহাড় পুড়িয়ে ন্যাড়া করা হয়েছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানতে পারি প্রতিবছরই জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়া হয়, এবছর একটু বেশী জায়গায় আগুন দেয়া হয়েছে, তবে অতিরিক্ত কিছু করলে প্রশাসন নিশ্চয় বিষয়টি দেখবে।
রাঙামাটির পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শাইনিং হিল এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, পরিবেশের ক্ষতি না করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যদি জুম চাষ করা যায় তাহলে পরিবেশও বাঁচবে কৃষকরাও লাভবান হবে। কৃষি বিভাগ ও সরকার এবিষয়ে উদ্যেগ নিতে পারে।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক পবন কুমার চাকমা জানান, বেশীর ভাগ পাহাড়ী জুম চাষের উপর নির্ভর, বছরে একবার পাহাড়ে আগুন দেয়ার পর তারা সারা বছর ধরে কোন না কোন ফসল ফলাচ্ছেন তাদের ১২ মাসই ফসল ফলানোর জন্য উদ্ধুর্ধ করা হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবছর ফসল ভালো হবে বলে তিনি আশা করেন।
কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা আরো জানান, জুম চাষীদের নিজেদের গন্ডীর মধ্যে আগুন দিতে বলা হয়েছে যাতে অন্যদের বা পরিবেশের ক্ষতি না হয়।
জুম চাষীদের আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পরিবেশ বান্ধব জুম চাষে উৎসাহিত করার পাশপাশি তাদের প্রতি সরকারের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে চাষীরাও উপকৃত হবে ভালো ফলনের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হবে বলে বিশেষজ্ঞন মনে করছেন।