সময় কত দ্রুত বদলে যায়! গত বছরেই যাঁকে নিয়ে ছিল প্রশংসার ফুলঝুরি আর আজ তাঁর বিরুদ্ধেই কথার তির! কথা উঠছিল-২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে পারেন এবং বিশ্বের শক্তিশালী একটি দেশের নেতৃত্ব দিতে পারেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। কিন্তু এখন বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম কোম্পানি ফেসবুকের নেতৃত্ব দিতে তিনি সক্ষম কিনা কিংবা ২১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী তাঁর ওপর আস্থা রাখবে কিনা সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা নামের একটি নির্বাচনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফেসবুক থেকে তথ্য হাতিয়ে ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় জাকারবার্গকে তীব্র সমালোচনা করছেন রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষকেরা। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পাঁচ দিন পর্যন্ত চুপচাপ ছিলেন জাকারবার্গ। পরে অবশ্য মুখ খুলেছেন এবং ঘটনা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। তবে এ ঘটনায় যে বিশাল আস্থার সংকটের মুখোমুখি হতে হবে তা তিনি আগে উপলব্ধি করতে পারেননি।
অপপ্রচার, ভুয়া খবর ঠেকাতে ফেসবুকের ব্যর্থতা নিয়ে কয়েক মাস ধরে সরব ইউরোপ-আমেরিকার রাজনীতিবিদেরা। তাঁদের চোখে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ কারণে কংগ্রেসের সামনে পরীক্ষা দিতে হবে জাকারবার্গকে। তাঁকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তথ্য বেহাত হওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকে ফেসবুকের শেয়ারের দাম ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। উড়োজাহাজের ব্ল্যাক বক্সের মতো তথ্য সংগ্রাহক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তথ্য তুলে দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষা বলছে, অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক সামাজিক যোগাযোগের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করে না বলেই মত দিয়েছেন। ফলে মার্ক জাকারবার্গ আর তাঁর ফেসবুককে দ্রুত বদলানো ছাড়া উপায় নেই।
আসক্তির এক খেলা
ফেসবুকের ব্যবসা মূলত উপাদানের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ব্যবহারকারীকে ফেসবুকের স্ক্রিনে বেশিক্ষণ আটকে রাখা, তাঁদের আচরণ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা দাঁড় করিয়ে ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে বানানো বিজ্ঞাপন দেখিয়ে কোটি কোটি ডলার কামানো। যেসব উপাদান ব্যবহারকারীদের কাছে আকর্ষণীয় এবং অন্যের কাছে বিজ্ঞাপন বিক্রি করতে সাহায্য করে তাদের জন্য ইনসেনটিভ কর্মসূচি আছে ফেসবুকের। প্রতিষ্ঠানটির ভোটিং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ জাকারবার্গের হাতে। বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁর সমালোচনা করার মতো মানুষ কম।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রথম এ বিতর্কের সূচনা হয়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমেরিকান নাগরিকদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছিল তথ্য বিশ্লেষণ করার প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকের কোটি কোটি ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
মার্ক জাকারবার্গমার্ক জাকারবার্গসিএনএন বলছে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলেক্সান্ডার কোগানের তৈরি অ্যাপ্লিকেশন ‘দিসইজইওরডিজিটাললাইফ’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ফেসবুক। এর ফলে ব্যবহারকারীদের তথ্য জোগাড় করার সুযোগ পান ওই অধ্যাপক। ওই অ্যাপ মূলত একটি ব্যক্তিত্ব বিষয়ক পরীক্ষা চালাত। কিন্তু যেসব ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই অ্যাপ ডাউনলোড করতেন, তাঁরা আলেক্সান্ডার কোগানকে নিজেদের বিভিন্ন তথ্য নেওয়ার অনুমতিও দিতেন। এর ফলে ব্যবহারকারীদের অবস্থান, তাঁদের বন্ধু ও যেসব পোস্টে তাঁরা ‘লাইক’ দিতেন, সে সম্পর্কে জানতে পারতেন মনোবিজ্ঞানের ওই অধ্যাপক। ওই সময় ফেসবুকের নিয়মনীতির মধ্যেও এ কার্যক্রম অনুমোদিত ছিল।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ব্যবহারকারীদের ওই তথ্যাবলি কোগান কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার কাছে সরবরাহ করেন। ফেসবুকের নীতিমালা ভঙ্গ করেই এ কাজ করেন তিনি। ফেসবুকের পাঁচ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর তথ্য এভাবে বেহাত হয়ে যায়।
ওই সময় কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা ভোটারদের প্রভাবিত করা যাবে, এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিল। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, ২০১৫ সালে কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকাকে ওই সব তথ্য মুছে ফেলতে বলেছিল তারা। কিন্তু কয়েক দিন আগে জাকারবার্গের প্রতিষ্ঠান জানতে পারে, ওই তথ্যভান্ডারের সবটুকু মুছে ফেলা হয়নি।
ফেসবুক দাবি করেছে, ওই গবেষক ও কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা ফেসবুকের নিয়ম ভেঙেছে। তবে নিজেদের দোষ স্বীকার করেননি ওই গবেষক এবং কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকা। তাদের দাবি, ফেসবুকের নিয়মনীতির বাইরে যায়নি তাঁরা। ফেসবুকের তথ্য বেহাত হওয়া এবং তা ভোটে প্রভাব ফেলতে কাজে লাগানোর ঘটনা শুনে সমালোচনা শুরু করেন রাজনীতিবিদেরা। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকেরা বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। যদিও ফেসবুক ২০১৫ সাল থেকেই এ বিষয়ে জানত কিন্তু ব্যবহারকারীদের সতর্ক করেনি। অবশ্য ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার ভূমিকা কতটুকু তা এখনো পরিষ্কার নয়।
কিন্তু এসব বিষয় জাকারবার্গকে সুরক্ষা ঢাল দেবে না। তাঁর বিরুদ্ধে প্রাইভেসি পরিবর্তনে ধীরে চলো নীতি, ভুয়া জেনেও চুপ থাকা ও ভুল স্বীকারে অনিচ্ছার বিষয়টির সঙ্গে মিলে যায়। অথচ, ২০১৭ সালের শুরুর দিকে জাকারবার্গ ভুয়া খবর নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে বলে যে কথা উঠেছিল তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘এটা প্রলাপ’। গত সেপ্টেম্বরে ফেসবুক জানায়, ক্রেমলিনভিত্তিক এক প্রতিষ্ঠান তাদের প্ল্যাটফর্মে এক লাখ ডলার খরচ করে তিন হাজার বিজ্ঞাপন কেনে। রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানের দেওয়া বিজ্ঞাপন ১৫ কোটি মানুষ দেখে এ তথ্য তারা আগে জানায়নি। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনদাতাদের সঠিক তথ্য সব সময় দেয় না ফেসবুক।
ফেসবুককে নিষিদ্ধ করা বা ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার পরিবর্তে এর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা জোরেশোরেই বলছেন নিয়ন্ত্রকেরা। ইউরোপে ডিজিটাল ট্যাক্স, অ্যান্টি ট্রাস্ট মামলার মতো নানা বিষয় নিয়ে ফেসবুককে আটকানোর চেষ্টা চলছে। সবচেয়ে বড় কথা-আস্থা হারিয়ে অনেকেই ফেসবুক বিমুখ হয়ে উঠছেন। ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা শ্রেণি ফেসবুক থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজারে এ বছরে প্রথমবারের মতো ফেসবুকের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের আয় কমার ঘটনা ঘটতে পারে। যে নেটওয়ার্ক সুবিধা বা প্রভাবের কারণে ফেসবুকে নতুন ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ সৃষ্টি করা হতো ফেসবুক সংকুচিত হলে এখন উল্টো ঘটনা ঘটবে। ফেসবুকের মূল্য এখন ৪৯ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার কিন্তু এর দৃশ্যমান সম্পত্তি মাত্র এক হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। ফেসবুকের এ মূল্য অস্থাবর এবং সম্ভাব্য, ক্ষণস্থায়ী।
যদি জাকারবার্গ তাঁর প্রতিষ্ঠান ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য সঠিক কিছু করতে চান তবে বিশ্বস্ততার জায়গা আবার ঠিক করতে হবে। এখন পর্যন্ত ফেসবুকের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অ্যাপ পরীক্ষা করা, ডেভেলপারদের তথ্য সংগ্রহে বাধা দেওয়া ও যেসব অ্যাপ তথ্য সংগ্রহ করে তার নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারকারীর হাতে দেওয়ার মতো কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
তবে জাকারবার্গের এ প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিভিন্ন কনটেন্ট, প্রাইভেসি, তথ্য ও নির্বাচনে তাদের ভূমিকা নিয়ে ফেসবুকের একটি পরিপূর্ণ, স্বতন্ত্র পরীক্ষা চালাতে হবে। এ স্বতন্ত্র পরীক্ষার ফল জনসম্মুখে প্রকাশ করার বিষয়েও মতামত প্রকাশ করা হয়। তথ্য বেহাত হওয়া, ভুয়া খবরের প্রাদুর্ভাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন তথ্য প্রতিবছর প্রকাশ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খেলায় যেমন রেফারি দরকার হয় তেমনি ডাটা সুরক্ষায় স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন করা যেতে পারে।
মার্ক জাকারবার্গ। ফাইল ছবিমার্ক জাকারবার্গ। ফাইল ছবিএ ছাড়া ফেসবুকসহ অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ ও পদ্ধতিগতভাবে উন্মুক্তভাবে তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা করতে পারে। তারা ‘ডাটা রাইটস বোর্ড’ গঠন করে তাদের দিয়ে তথ্য নিরাপত্তা পরীক্ষা করাতে পারে। এ বোর্ডের কাজ হবে-ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন না করে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র গবেষকেদের কাছ প্ল্যাটফর্মের তথ্য যাচাই করে সে অনুযায়ী নিয়মনীতি ঠিক করা। এ নিয়ে সফটওয়্যার তৈরি করা যেতে পারে। ফেসবুকে লাইক নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুদে এই টুল কিভাবে কাজ করে? ফেসিয়াল রিকগনিশন অ্যালগরিদম কিসের ভিত্তিতে পরিবর্তন করা হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর উদাহরণসহ তারাই দেবে। যে বোর্ড বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান মূলত কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে রেফারি হিসেবে কাজ করতে পারে।
রেফারি হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি স্বতন্ত্র তথ্য সুরক্ষার প্রটোকল ঠিক করবে বোর্ড। ইউরোপের নতুন আইন ‘জেনারেল ডাটা প্রটেকশন রেগুলেশন’ অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ফেসবুক ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছে ফেসবুক। এতে অনলাইনে যাতে কেউ ট্র্যাক করতে না পারে ব্যবহারকারীদের হাতে কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ফেসবুকের এসব নিয়মনীতি ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা তা কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা সমস্যা সমাধানে যৌথভাবে কাজ করে সফলতা পেয়েছে। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার খাতে মান ঠিক করা, ইন্টারনেট ডোমেইন নাম ঠিক করার মতো বিষয়গুলোতে যৌথভাবে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুশ্চিন্তা হলেও আসলে একযোগে কাজ না করলে সমস্যা সমাধান হবে না। তখন সরকারি হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
ফেসবুক অবশ্য ভাবছে পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন আনলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে তা হবে না। অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীর তথ্যের ওপর নির্ভর করে তাদের পুরো ব্যবসা ঝুঁকির মুখে পড়বে। মানুষ সচেতন হলে পয়সা ছাড়া তাদের তথ্য নেওয়া এবং তা কাজে লাগিয়ে মুনাফা করা কঠিন হয়ে যাবে। প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিজ্ঞাপনমুক্ত হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অর্থ নিতে হবে বলে মানুষ এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার ছেড়ে দেবে। সহজে মুনাফা আসবে না। ধারণা করা হচ্ছে, যদি ফেসবুকের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় তবে এর আয় ৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এটা কি জাকারবার্গের খুব বেশি ভালো লাগবে?
নিউজটি প্রথম আলোর সৌজন্য প্রচারিত