মরণ ব্যাধি ক্যান্সার আর কিডনি’র সাথে যুদ্ধ করে বেছে আছি : মোস্তফা কামাল

প্রকাশঃ ২২ মে, ২০১৮ ০৯:০৩:২৪ | আপডেটঃ ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৯:৪১:১২
১৭ এপ্রিল, ২০১৮, আজ প্রায় ১ মাস পড়ে ল্যাপটব সাথে নিয়ে বসলাম। ১২ মার্চ অসুস্থ্য হওয়ার পর থেকে আর  থেকে আর ল্যাপটবে হাত দেয়া হয়নি। মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোনের  ছোট বার্তা, ফেইজ বুকের স্ট্যাটাস দিয়েই সময় পার করার সাথে সাথে নিজেকে কিছুটা হাল্কা করার চেষ্টা করেছি।

১৭ মে সকাল  পৌনে আটটা এখন। বিএসএমএমইউ এর সি ব্লকের কিডনি বিভাগের ৪১৯ নং ওয়ার্ডের ১৬ নং বেডে বসে বসে উপরের শিরোনামে কিছু লিখার প্রচেষ্টা । এ যাত্রায় গত ১৯  এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ্য হওয়ার পর প্রথমে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল  পরে  একই দিনেই চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ম্যাক্স হাসপাতালে দুই লক্ষ টাকার মতো খরচ করেও শারীরিক পরিস্থিতির কোন উন্নতি না হওয়ায় ২৮ এপ্রিল বিকাল ৪ টা ৩০ মিনিটের রিজেন্ট এয়ারে করে ঢাকায় এসে  সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় পৌছে বন্ধু নাজিমের বসুন্ধরার টেনামেন্ট  নাইন এ রাত্রিকালীন অবস্থান করে ২৯ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৬ টায় রওয়ানা হই  বিএসএমএমইউর এর উদ্দেশ্য রওয়ানা হওয়ার পর সকাল সাড়ে ৭ টা নাগাদ পৌছাই কাংখিত বিএসএমএম ইউ (পিজি হাসপাতাল) এ।

পেশাগত এবং বিভিন্ন কারনে একাধিক বার ঢাকা আসার পর প্রতিবার বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া আসার সময় একাধিকবার  বিএসএমএমইউর পাশ দিয়ে যাওয়া, আজিজ সুপার মার্কেটের দোকানে ঘোরাফেরা করলেও বিএসএমএমইউর মূল এরিয়ায় প্রবেশ করা হয়নি। যাই এখানে এসেই সেলিম খালু, মাহবুব ভাই দুজনই আউটডোরে টিকিট  কাটার উদ্দেশ্যে খবরা খবর নিতে শুরু করলেন । আমি আর জাহিদা একেক সময় একেক একেক জায়গায় বসে অপেক্ষায় ছিলাম। আগেই শুনেছি বিএসএমএমইউ তে ভর্তির জন্য সিট পাওয়া খুবই কষ্টের  এবং কঠিন তাই মোটামুটি আতংকের মধ্যেই ছিলাম। ইতিমধ্যে কলেজ জীবনের বন্ধু বোরহান এবং কিছুক্ষণ পর সুজন এসে আমাদের সাথে যুক্ত  হলো। শ্রদ্ধেয়  রানা ভাই তাঁর মাধ্যমে ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মহোদয় এর মোবাইল ফোন, বন্ধু সুজনের স্ত্রী সহ আরো অনেকের সহযোগিতায় বিএসএমএমইউতে ভর্তির জন্য সর্বাতœক চেষ্ঠার পর দুপুর ২ টা নাগাদ শেষ মূহুর্তে এসে নেফ্রোলজির আউট ডোরের চিকিৎসক ডা: শাহেদের বদান্যতায়  একটি সিট পেলাম। অবশ্য একই সাথে জানতে পারলাম আমার নামে একটি কেবিন ইস্যু হয়েছে। যেহেতু পে সিটের পেমেন্ট হয়ে গেছে সেহেতু বেড রেখে কেবিন ক্যানসেল করে দিলাম। বিকাল ৩ টা নাগাদ সি ব্লকের কিডনি বিভাগের ৪১৯ নং ওয়ার্ডের ১৫ নং পেইং বেডে উঠে খুবই শান্তি পেলাম। পাশাপাশি  ওয়ার্ডের সুন্দর, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবশে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম । ২০১২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রাইভেট  ক্লিনিক এর কেবিনে চিকিৎসা  নেয়ার পর প্রথম বারের মতো সরকারী হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি হলাম বিধায়  কিছুটা চিন্তিত ছিলাম । যদিওবা বিএসএমএমইউ এর সকল খরচ রোগীর নিজের । এটাও অনেকটা প্রাইভেট ক্লিনিকের মতো। তবে এখানকার দেশ সেরা চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায় । জুনিয়র চিকিৎসক রা ২৪ ঘন্টা রোগীর সেবায় তৎপর।
বিএসএমএমইউ এর  চিকিৎসা সেবায় কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করলাম, তা হলো সরকারী বন্ধের দিন এবং প্রতি শুকবার  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গন ছুটিতে থাকেন  । এখানে এসব দিন  রোগীদের কাছে ছুটির দিন হিসাবে পরিচিত।



যাই হোক সিটে ভর্তি হওয়ার পর পরই কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার এসে রোগের বিস্তারিত বর্ণনা নিয়ে গিয়ে কেইস ফাইল রেডি করলো । সাথে থাকা সকল কাগজ পত্র বুঝে নিল।
৪১৯ নং ওয়ার্ডের ১৮ টি বেডের মধ্যে ৬ টি বেড হচ্ছে পেইং বেড। বেডগুলো হচ্ছে ১,২,৩,১৫,১৬,১৭। অবশিস্ট ১০টি বেড ফ্রি। পেইং বেড দিন প্রতি ভাড়া ২৫০ টাকা। ওয়ার্ডের সকল রোগীর জন্য তিনবেলা খাবার বরাদ্দ আছে । সকালে ১টি ডিম, ২টি কলা,৪ পিস পাউরুটি ।দুপুরে ভাত,ডাল,সব্জি, মাছ ্ এবং রাতের খাবার ভাত, ডাল,সব্জি, মুরগীর মাংস । বিকালে ১ প্যাকেট বিস্কুট আর রং চা। সকাল ৬ টায় সকালের নাস্তা, দুপুর ১২ টার মধ্যে দুপুরের খাবার আর সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে রাতের খাবার সরবরাহ করা হয়। খাবার পরিবেশন  এর স্বাস্থ্যকর এর বিষয়টা নিশ্চিত করা হয়। যদিওবা অনেক রোগী বরাদ্দকৃত থাবার গ্রহণ করেন না আবার প্রয়োজন বোধে কেই একাধিক  প্লেট গ্রহণ করতে পারেন। ওয়ার্ড থেকে অবিতরনকৃত খাবার ফেরৎ নেয়ার ব্যাপারে ওয়ার্ড বয় কিংবা খালাদের কোন আগ্রহই নেই, শুনে কিছুটা অবাক হলাম ।

পরের দিন সরকারী বন্ধ থাকার কারনে  রোববার ছিল ছিল ছুটির দিন  আবার একদিন পর মঙ্গলবার আর বুধবার দুদিন সরকারী ছুটির পর শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুট বিধায় প্রথম সপ্তাহ  চিকিৎসার খুব একটা অগ্রগতি পায়নি । তথাপি রুটিন মাফিক চেক আপ, ডায়লিলিসি দেয়া , বিভিন্ন রক্তের পরীক্ষা নিয়মিত চলছিল। মাঝখানে শনিবার এবং বৃহস্পতিবার দু দিন প্রফেসর সাহেব  এসে দেখে গেলেন। হাসপাতালে অবস্থানকালীন জানতে পারলাম প্রতিটি বেডের বিপরীতে একজন করে শিক্ষানবীশ চিকিৎসক (যারা এমবিবিএস করার পর এফসিপিএস অথবা ডিপ্লোমা করার জন্য এখানে ভর্তি) বরাদ্দ রয়েছে। দিন চারেক পর জানতে পারলাম আমার বেড ডাক্তার হচ্ছেন ডাঃ মিলন। বেড ডাক্তাররা প্রতিদিন সকালে এস রোগীর নিয়মিত চেক আপ, বিপি এবং হার্টবিট কাউন্ট করার পাশাপাশি অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করেন এবং প্রফেসর সাহেবদের ভিজিটিং আওয়ারের সময় রোগীর রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এসময় প্রশিক্ষনার্থী ৩০ হতে ৩৫ জন শিক্ষানবীশ চিকিৎসক উপস্থিত থাকেন। এটি তাদের কাছে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাশের মতো। লক্ষ্য করলাম শিক্ষানবীশ চিকিৎসকগন এসময় অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্থ থাকেন। প্রফেসর সাহেবদের চাহিদা মোতাবেক প্রশ্নের ঊত্তর দিতে ভুল হয় কিনা এ বিষয়ে টেনশনে থাকেন। প্রফেসর স্যার যতক্ষণ ওয়ার্ডে থাকবেন ততক্ষণ রোগী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেন না। একই ওয়ার্ডে লাল, সবুজ, হলুদ ইউনিট ভাগ রয়েছে এবং এ হিসাবে প্রফেসর সাহেবদের জন্যও বেড বরাদ্দ আছে । প্রত্যেক রোগীকে নেফ্রোলজি বিভাগের একজন অধ্যাপক কিংবা সহকারী অধ্যাপকের আন্ডারে রাখা হয়। নেফ্রোলজির ডাক্তার যদি  মনে করেন রোগীকে অন্য বিভাগের ডাক্তার দেখানো দরকার তখন তিনি সংশ্লিস্ট প্রফেসরের মাধ্যমে রেফারেন্স ফরম পাঠালে  অন্য বিভাগের অধ্যাপক গন এস রোগীকে দেখে যান।



বিএসএমএমইঊতে  বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা সহ সকল পরীক্ষা করানো হয় নিজস্ব ল্যাবে। প্রতিটি পরীক্ষার বিপরীতে নির্ধারিত মূল্য ব্যাংকে পরিশোধের পর পরীক্ষা করা হয়। জরুরী পরীক্ষার ক্ষেত্রে আ্ইসিইউএর ল্যাব ব্যবহার করা হয়। সিটি স্ক্যান ছাড়া অন্যান্য সকল পরীক্ষা এখানে তূলনামুলক ভাবে কম। ব্ল্যাড ব্যাংক সর্বদা খোলা থাকে।


মোঃ মোস্তফা কামাল
১৬ নং বেড, ৪১৯ নং ওয়ার্ড, কিডনি বিভাগ
বিএসএমএমইউ।