পিতৃহীন চাঁদনী মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে সাঁওতালদের প্রথম সরকারি চাকরিজীবি হলেন

প্রকাশঃ ১৪ মে, ২০১৮ ০৭:৫০:৩৩ | আপডেটঃ ০৯ অক্টোবর, ২০২৪ ০৩:৩৬:৪৪
বিশেষ প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি। পাহাড়ে সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠির বসবাস আছে, সেটি অনেকেরই অজানা। তাই পাহাড়ের সাঁওতালদের বঞ্চনার ইতিহাস তো আরো বেশি অজানা থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই বঞ্চনার প্রাচীর ভেঙ্গেই প্রথম সরকারি চাকরির যোগ্যতা অর্জন করেন, পানছড়ির চাঁদনী সাঁওতাল। যিনি দুই বছর বয়স থেকেই বাবাকে দেখেননি। সেই থেকেই দাদু’র বাড়িতে মা সুমি সাঁওতাল-ই চাঁদনীকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। বর্তমানে তিনি পানছড়ির গোলক প্রতিমামুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষকতার পাশাপাশি খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ইতিহাস (অনার্স)-এ চতুর্থ বর্ষের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৯৫ সালের ১০ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের সাঁওতাল পাড়ায় চাঁদনী’র জম্ম। দুই বছর যখন বয়স, তখন বাবা সুনীল সাঁওতাল নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তখন থেকে দাদু’র বাড়িতে মা সুমি সাঁওতাল একমাত্র সন্তান হিসেবে বুকে আগলে বড়ো করেছেন। নিজেদের বাড়ি-ভিটে কিছুই নেই। মানুষের বাড়িতে-জমিনে কাজ করে মা-ই আমাকে এতোটা পথ পাড়ি দেবার সাহস জুগিয়েছেন, বলছিলেন চাঁদনী সাঁওতাল।
২০০৩ সালের নন্দু চাকমা নামের এক শিক্ষকের সহযোগিতায় চাঁদনী’র ঠাঁই হয় খাগড়াছড়ি জেলাশহরের সরকারি শিশু সদন-এ। এখান থেকেই একমাত্র সাঁওতাল শিক্ষার্থী হিসেবে ২০১১ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এর আগে খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলার সাঁওতালদের কোনই ছেলে বা মেয়ে এস.এস.সি. পাশ করতে পারেনি।
চাঁদনী’র মা সুমি সাঁওতাল বলছিলেন, বাবাদের একসময় অনেক জমিজমা ছিলো। শিক্ষার অভাবে সব বেহাত-বেদখল হয়েছে। দু বেলা একমুঠো ভাতের জন্য নিজেরাই নিজেদের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। তাই জেদ ছিলো, শত কষ্টে-প্রতিকূলতায় মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবো। যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই আশা বুকে নিয়েই দূর পানে চেয়ে আছি।
চাঁদনী খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েই প্রাইভেট টিউশনি’র দিকে মনোযোগ দেন। নিজের খরচ এবং মায়ের খরচ যোগাতে থিতু হন, জেলাশহরের উপজেলা কোয়ার্টারে। রবীন্দ্র বড়–য়া নামের এক কর্মচারী’র সাথে সাবলেট হন। ২০১৪ সালে সফলতার সাথে শেষ করেন, এইচএসসিও।
চাঁদনী বলেন, বাড়িতে আসলে মায়ের মুখটা দেখলে কেনো জানি বুক ফেটে যাবার উপক্রম হতো। আমার জন্য আমার মা, এখনো দিনমজুরী করেন। এটা ভাবতে গেলেই জীবনটাকে অসহনীয় মনে হতে থাকে। কিন্তু আমার মা, আমার এই অব্যক্ত বেদনা কিভাবে জানি বুঝে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘তোমাকে আমি শিক্ষার সর্বোচ্চ জায়গায় দেখতে চায়’।
বুকে মায়ের সাহস নিয়ে ভর্তি হলাম, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ইতিহাস (অনার্স)-এ। সাথে সাথে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও এটন্ড করতে থাকলাম। নানা বাস্তবতায় সরকারি চাকরি পাবো এমন আশা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। এরিমধ্যে ‘ব্র্যাক-এডিবি’-এর একটি প্রকল্পে কিশোরী উন্নয়ন কাজে যুক্ত হলাম। প্রকল্প শেষ আবার বিরতি। এই ফাঁকে খাগড়াছড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট’-এর সাঁওতাল জনগোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্পে সহকারি নিযুক্ত হই। এই সূত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী’র সাথে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করি। তিনি উদ্বুদ্ধ করলেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে।
চাঁদনী বললেন, ইন্টারভিউ কার্ড আসলো। যথারীতি লিখিত পরীক্ষায় ভালো করলাম। তবু কেনো জানি মন সায় দিচ্ছিল না। ভাইবা দিতে গিয়েই দেখি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আগ বাড়িয়ে বললেন, তুমি ভালো করেছো। তোমার চাকরি হবে।

২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে পানছড়ি উপজেলার গোলকপ্রতিমামুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহাকরি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত চাঁদনী নিজের সম্প্রদায়ের শিশুদের ঝরে পড়া রোধ, স্কুলমুখী করা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও একনিষ্ঠ।
তিনি বললেন, জীবনে এতোটুক আসার পেছনে মায়ের পাশাপাশি নন্দু চাকমা স্যার, পানছড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা স্যার, নিজের কমিউনিটির অগ্রজ মানিক সাঁওতাল এবং স্থানীয় শিক্ষক বিজয় কুমার দেব’র অবদান স্মরণীয়।
জীবনে সামনে একটাই স্বপ্ন, নিজের উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করা এবং কর্মজীবনে আরো অনেক বড়ো অবস্থানে চলে যাওয়ার সংগ্রামেই নিয়ত থাকতে হবে। কারণ, আমাকে আমার মায়ের মুখে ফোটাতে হবে হাসি আর বুকে দিতে হবে সাহসের ভান্ড।