পাহাড়ের গণমাধ্যম কর্মীদেরকে আপনার মতো মানুষ মনে করুন প্রদীপ চৌধুরী

প্রকাশঃ ৩০ মার্চ, ২০১৮ ০৯:২১:৩২ | আপডেটঃ ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ ০১:৫৫:১৭

সারাদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা প্রতিদিন পেশাগত অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। সেটা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক ও ধর্মীয় প্রসংগও হতে পারে। কিন্তু এসবের বাইরে কতোটা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন, পাহাড়ের সংবাদকর্মীরা; সেটা কিন্তু ভাবনারও অতীত।
পাহাড়ের সংবাদকর্মীদেরকে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে, পাহাড় বেয়ে, নদী ও ছড়ার উজান বেয়ে অথবা অবৈধ অস্ত্রের ভীতি উপেক্ষা করে সংবাদের সন্ধানে ছুটতে হয়। সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান অথবা সরকারি কর্তারাও সংবাদকর্মীদের খুব বেশি দরদ করেন এমন না। তাহলে সংবাদকর্মীরা কী আজব কিছু? তাঁরা কী মানুষ নন? তাঁদের কী ভাত-কাপড়ের চিন্তা নেই?
পাহাড়ের সাংবাদিকতা খুব বেশি যোগ্যতা নির্ভর নয়, এটাও স্বীকার করা যৌক্তিক। আমি খুব অহংকারের সাথেই বলি, সমতলের তুলনায় পাহাড়ের সাংবাদিকতা এখনও অনেক বেশি পেশাদার এবং নিবেদিতও। তিন পার্বত্য জেলায় বছরের পর বছর, দশকের পর; সাংবাদিকতা করেও কেউই পেশার কামাইয়ে গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। যাঁরা পেরেছেন তাঁরা পেশার সাথে অন্যকিছু করেছেন। কেউ ব্যবসা, কেউ ঠিকাদারি, কেউ অন্য আরো আরো.. .. .. ।
বিগত দুই দশকে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চুক্তি’-র বদৌলতে বিপুল পরিমান দেশি-বিদেশি মানুষ-গবেষক-চিন্তক আর অনুসন্ধিৎসু পাহাড়ে আসেন। ফিরে গিয়ে ব্যক্ত করেন নিজের অভিমত। দেশি-বিদেশি জর্ণালেও তুলে ধরেন নিজস্ব মতামত। তাঁদের বেশিরভাগই দোষের পাল্লায় বেশি ফেলেন সংবাদকর্মীদের।
তাঁরা (গবেষকরা) সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করেন সাংবাদিকদের। পাহাড়ের সংবাদকর্মীরা লেখাপড়া জানেন না, অন্য কোন চাকরি পাবার মতো যোগ্য নয়, সরকারি বাহিনী-জেলা পরিষদ-উন্নয়ন বোর্ড আর জনপ্রতিনিধিদের চামচাগিরি করেন; এমন অভিযোগ শুনতে শুনতে আর গবেষণাকর্মে দেখতে দেখতে এন্তার বিরক্ত হই।
কী করবো, ভেবে কুল পাইনা।
‘পার্বত্য চুক্তি’র পর অনেকে মনে করেন, পাহাড়ে গণতন্ত্রের চর্চা অবাধ হয়েছে, মুক্তমত প্রকাশের পরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে অথবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিকশিত হয়েছে। আসলে কী তাই?
বরং চুক্তির পর পাহাড়ে সাম্প্রদায়িকতার গণতন্ত্র, শিক্ষার বৈষম্য, চাঁদাবাজির বৈধতা, পূর্নবাসন নির্ভর জেলা পরিষদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিয়োগের নামে ভয়াবহ অনৈতিকতার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সেই চর্চায় সংবাদকর্মীদের অংশগ্রহণ কীইবা থাকতে পারে?
আপনি পাঠক, আপনার লেখাপড়া না জানা-অযোগ্য-বয়স যায় যায়- আর কোথাও চাকরির কোন সম্ভাবনা নেই-মুক্ত বিদ্যালয় থেকে কেনা সনদই সম্বল; এমন স্বজনকে যে কোনভাবে চাকরি হাতিয়ে দিচ্ছেন!
আর সংবাদকর্মীদের দোষারোপ করছেন, ‘আপনাদের কাজ কী’?
এমন দূরাবস্থায় থাকতে থাকতে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘পাহাড়ের সংবাদকর্মী, তুমি কার?
চাকরিতে বৈষম্য, এনজিওতে বৈষম্য, প্রকল্প গ্রহণে বৈষম্য এমনকি ত্রাণ কার্যক্রমেও বৈষম্য; এমন একটি সমাজে ন্যায্যতার প্রশ্ন তোলা কী অসমীচিন?
সংবাদকর্মীদের কাছে, এই প্রশ্নগুলোই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সুশীল সমাজ-নাগরিক সমাজ-এনজিও সমাজ-সচেতন সমাজ-অসাম্প্রদায়িক কণ্ঠ-উদারপন্থী-নিরপেক্ষতায় আসক্ত অথবা কোন রাজনৈতিক শক্তি; কেউ কী কখনো সংবাদকর্মীদের কাছে এতাসব অসঙ্গতির জবাব খুঁজেছেন?
যদি বলি, একজন সংবাদকর্মী একজন  পিয়ন বা বার্তা বাহক। সংবাদে তাঁর নিজের মতামত প্রকাশ করা কোনই সুযোগ নেই। সমাজের কেউ না কেউ কথা না বললে, কোন প্রকার অভিযোগ উত্থাপন না করলে; একজন সংবাদকর্মীর পক্ষে সাদামাটা কোন প্রতিবেদন করা আসলেই দুরুহ।
আমি সাংবাদিকতার ছাত্র বা সাংবাদিকতা জ্ঞানে খুব বেশি অভিজ্ঞ নই বলে, এ বিষয়ে বিতর্কেও জড়াতে চাই না।
আপনিই একজন সচেতন পাঠক, বিশ^বিদ্যালয় অথবা বিদেশি বিশ^বিদ্যালয় থেকেও জ্ঞান নিয়ে এসেছেন। আপনি কেনো সচেতনভাবে সংবাদকর্মীদের বিব্রত করেন?
সাধারণত: তিন পার্বত্য জেলায় যাঁরা সংবাদকর্মে যুক্ত তাঁদের বেশিরভাগই অরাজনৈতিক। খুব কম সংখ্যক সংবাদকর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে, যাঁরা ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন। আর যদি করেও থাকেন, তাতে বেশিরভাগ প্রগতিশীল রাজনীতির সাথেই সম্পৃক্ত ছিলেন।
ধর্মাশ্রয়ী এবং সাম্প্রদায়িক ছাত্র রাজনীতির সাথে ছিলেন এমন সংবাদকর্মীরাও নানাভাবে মিশে গেছেন মূলধারায়। তাহলে কেনো সংবাদকর্মীদের পক্ষপাতদুষ্ট ভাবা হবে?

প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী।