প্রকাশঃ ২০ অগাস্ট, ২০১৯ ০৩:০৪:৫১
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:৩২:০৭
সিএইচটি টুডে ডট কম, বান্দরবান। ঘনঘোর শ্রাবণে ভরা বর্ষায় উন্মাতাল কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার অসংখ্য ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দামতুয়া ঝর্ণা, ওয়াংপা ঝর্ণা, রূপমুহুরী ঝর্ণা ও নুনার ঝিরি ঝর্ণা। শুধু এসব ঝর্ণা জন্যই নয় একই সাথে উচ্ছ্বল কলরবে লাফিয়ে চলছে দামতুয়া জলপ্রপাত ও তামাং ঝিড়ি জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানির ধরা। এসব ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের হিমশীতল জলে সিক্ত হতে প্রতিনিয়ত আসছে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকরা।
জানা যায়, ২০১৭ সালে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ৯ যুবকের অনুসন্ধানে পাওয়া ওয়াংপা ঝর্ণা এবং দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতকে ঘিরে আজকের এই আয়োজন।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলার সবুজ পাহাড়ের অন্দরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য ঝর্ণা। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের নজর পড়েছে ওয়াংপা ঝর্ণা, দামতুয়া ঝর্ণা । প্রকৃতির অপরূপ নিদর্শন এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের উপচেপড়া ভরা যৌবন দেখার মোক্ষম সময় এই শ্রাবণেই। বর্ষা শুরু হলে ঝর্ণা ও জলপ্রপাতগুলোতে যেন টিকরে পড়ে যৌবন স্রোত। সবুজ পাহাড়ের অন্তর্বিহীন নিস্তদ্ধতায় ঝর্ণা রাণীরা যেন আছল বিছিয়ে দেয় পর্যটকদের অভ্যার্থনা জানাতে! তাই সবুজের টানে প্রাণের উচ্ছ্বাসে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত এসব দেখতে ছুটে আসছেন পর্যটকরা।
আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার পয়েন্টের আদু মুরুং পাড়া থেকে ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার দুরে দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের অবস্থান। ১৭ কিলোমিটার পথ জীপ অথবা মোটর বাইকে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হয় পায়ে হেঁটে। পর্যটকদের সাম্প্রতিক নজরে আসা ওয়াংপা ঝর্ণা এবং ‘দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাত প্রকৃতির একটি বিস্ময়। এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের আকার আকৃতি ও গঠনশৈলী মনোমুগ্ধকর।
পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য নান্দনিক ঝর্ণার দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে এই ঝর্ণা গুলি অন্যতম। তবে সবচেয়ে মনোহর লাগে দামতুয়া ঝর্ণার কয়েক শত গজ উপরে দামতুয়া জলপ্রপাত দেখে। এ জলপ্রপাতের পাথরে মাটির ধাপগুলো আরো বিস্ময়কর। যেন সুদক্ষ রাজমিস্ত্রির নিপুন হাতে সৃষ্ট কোন আল্পনা! দামতুয়া জলপ্রপাত এর অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ প্রমাণ করে যে এটি প্রকৃতির খেয়ালে গড়া অসাধারণ একটি স্থাপত্যশৈলী।
অপরদিকে, দামতুয়া ঝর্ণা খাড়া পাহাড়ি দেয়াল বেয়ে কলকল, ঝমঝম রবে সুরের অনুরনণ তুলে উন্মাতাল স্রোত গড়িয়ে পড়ছে নিচের গভীর জলাশয়ে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা যেন সেখানে ম্লান। উঁচু থেকে পড়া পানির কিছু অংশ আবার জলীয় বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে সেখানে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এ যেন পাহাড়ের গভীরে মেঘমালা!
দামতুয়া ঝর্ণায় নামতে হলে খাড়া পাহাড়ের কিছুটা পথ ডিঙ্গিয়ে নীচে নামতে হয়। তবে দামতুয়া জলপ্রপাতে নামার পথ পাথুরে মাটি। সেখানে নামতে তেমন সমস্যা হয় না। ঝর্ণা ও জলপ্রাপাতের নীচে মাঝারী ধরণের জলাশয় আছে, এ জলশায়ে সাঁতার কাটতে ও গোসল করতে বেশ ভালো লাগে।
দামতুয়া ঝর্ণায় পৌঁছানোর অন্তত একঘন্টা আগে দেখা মিলবে ‘ওয়াংপা ঝর্ণা। মূল ওয়াংপা ঝর্ণা দেখতে হলে খাড়া পাহাড় বেয়ে নীচে নামতে হবে। চলাচল পথের মাঝে অসংখ্য ছোট বড় পাথরের ভাজে শীতল জল যেন জানান দেয় ওয়াংপা ঝর্ণা জলস্রোত কেমন হবে। ওপর থেকে ওয়াংপা ঝর্ণার পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আরো মনোহর লাগে।
প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। রাতে যদিও সেখানে অবস্থান করা নিরাপদ নয়। তবে তাবু খাটিয়ে অবস্থান করলে বুঝা যাবে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য ও কলতান।
প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ওয়াংপা ঝর্ণা, দামতুয়া ঝর্ণা । যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে। রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলতে পারে এর হিমশীতল জলে।
ধারণা করা হচ্ছে শতবর্ষ পূর্ব হতেই প্রবাহিত রয়েছে এসব ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। এতদিন সড়ক যোগাযোগ না থাকা, বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি জনপদ হওয়ায় তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে, ফলে তা অনাবিস্কৃতই থেকে যায়। উদ্যমী তরুন-যুবকরা পাহাড়ের কন্দরে লুকিয়ে থাকা এসব ঝর্ণা রাণী ও জলপ্রপাতকে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে আলীকদম উপজেলার পর্যটন পরিবেশ। নতুত্বের ছোঁয়া লাগছে পর্যটনখাতে। সরকারি আনুকুল্য পেলে এসব পর্যটন স্পট হয়ে উঠবে আরো পর্যটক বান্ধব।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক মো:মিজানুর রহমান জানান,দামতুয়া ঝর্ণা খুবই সুন্দর । এর পরিবেশ দেখলে যে কারোর মনই ভালো হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, প্রকৃতির এক সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর স্থান হলো এই দামতুয়া ঝর্ণা।
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার পর্যটন নিয়ে উপজেলা নির্বাহি অফিসার (ইউএনও) মো.সায়েদ ইকবাল বলেন, আলীকদম উপজেলার দামতুয়া ঝরনা দুর্গম হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক পর্যটক ঘুরতে আসে সেখানে। ওখানে রেস্ট হাউজ বা কটেজ না থাকায় পর্যটকরা আলীকদম সদরে অবস্থান করেন। আমাদের পর্যটন স্পটগুলো যাতে করে নষ্ট না হয় সেটি সংরক্ষণ করা দরকার ও জরুরী ভিত্তিতে তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং দুর্গম পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতের জন্য যাতে রাস্তা তৈরি করা যায় সে বিষয়ে সামনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, দামতুয়া ঝর্ণাসহ ওই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক এবং ওখানে যারা যাচ্ছে তারা স্থানীয় গাইড নিয়ে যাচ্ছে, তারা সেনাবাহিনী এবং আলীকদম উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেই যাচ্ছেন।
কিভাবে যাবেন : চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজার থেকে বাস করে চকরিয়া বাস স্টেশন নামতে হবে। চকরিয়া থেকে বাসে করে আলীকদম বাসস্টেশন নামবেন। সেখান থেকে জীপ গাড়ি ভাড়া নেওয়া যায়। অথবা বাস স্টেশন থেকে অটো রিক্সায় পানবাজার এসে ভাড়ায় চালিত মোটর বাইক নিয়ে আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটারের আদু মুরুং পাড়ায় নামবেন। সেখান থেকে স্থানীয় মুরুং গাইড নিয়ে উত্তর দিকে এক ঘন্টা হাঁটলেই পেয়ে যাবেন ‘ওয়াংপা ঝর্ণার ওপরের অংশ। ওখান থেকে আপনাকে দামতুয়া ঝর্ণায় যেতে আরো অন্তত একঘন্টা হাঁটতে হবে। পথে যেতে যেতে ৩টি স্থানে দেখা মিলবে পাহাড়ের ঢালে সবুজের বুকে ১০ থেকে ১২টি করে টং ঘর(পাহাড়ী জুম ঘর)। এসব স্থানীয় ক্ষূদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর ম্রো পাড়া। ওই এলাকায় কোন ধরনের ভয় নেই। এখানকার ম্রোরা অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ। তারা পর্যটক দেখলে প্রাণখোলে হাসি দেয়। অসংখ্য ঝিরি ও জঙ্গল মাড়িয়ে দেখা মিলবে দামতুয়া ঝর্ণা।
থাকার জায়গা : আলীকদমে গত কয়েকবছর ধরে পর্যটক থাকার জন্য বেশ কয়েকটি কটেজ ও হোটেল গড়ে ওঠেছে তার মধ্যে আলীকদম সদরে রয়েছে শৈলকুঠি রিসোর্ট, দ্যা দামতোয়া ইন, হোটেল আলীকদম। এছাড়াও পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রিত রেস্টহাউজেও থাকা যাবে। পর্যটকরা ইচ্ছে করলে স্থানীয় সেনাবাহিনীকে জ্ঞাত করে পাহাড়ি পরিবেশে মুরুং পাড়ায় ও থাকতে পারে।
সর্তকতা : চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না। পাহাড়ের ঝর্ণা ও জলপ্রপাতসমুহ দেশের মানুষের সম্পদ। অপচনশীল এসব আবর্জনা ফেললে পরিবেশ নষ্ট হয়। পথে জোঁক থাকতে পারে, তাই সতর্ক থাকবেন। লবণ সঙ্গে রাখলে ভালো হয়। জোঁক কামড়ালে লবণ ছিটিয়ে দিলে কাজ হয়। নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় গাইড ও পুলিশের সহায়তা নেয়া যেতে পারে।