পাহাড়ের এনজিও কার্যক্রম বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ? প্রদীপ চৌধুরী

প্রকাশঃ ১৯ অগাস্ট, ২০১৯ ০১:০১:২০ | আপডেটঃ ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ ০২:১২:৩৩
পার্বত্য শান্তিচুক্তি’র আগে তিন পার্বত্য জেলায় এনজিও কার্যক্রম একেবারে সীমিত পর্যায়েই ছিল। রাবেতা, ওয়ার্ল্ড ভিশন, কারিতাস, সিসিডিবি ছাড়াও কিছু ধর্মীয় আদলের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চোখে পড়তো। বিশেষ করে ধর্ম প্রচারের দিকেই এসব সংগঠনের কৌশলী মনোযোগ ছিল বেশি। সে সময়কার পরিস্থিতিও ব্যাপকভাবে সব জায়গায় এনজিও কার্যক্রম চালানোর সহায়ক ছিল না। তৎকালীন সরকার এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এনজিও কার্যক্রমকে বৈরিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ফলে বিদেশি এনজিও তো দূরে থাক, স্থানীয়ভাবে এনজিও গড়ে তোলা স্বপ্নেরও অতীত ছিল।

১৯৯৭ সালে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর তিন পার্বত্য জেলায় সরকারের সদিচ্ছায় ব্যাপক এনজিও কার্যক্রমের সূচনা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের বছর পূর্তি না হতেই ‘ব্যাঙের ছাতা’র মতো তিন পার্বত্য জেলায় এনজিও গড়ে তোলার হিড়িক পড়ে যায়।

জেলাশহর থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়েও এনজিও’র আধিক্য রীতিমতো সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। তিন পার্বত্য জেলার শত শত মেধাবী তরুণ ঝুঁকে পড়েন এনজিও কর্মকান্ডে। মোটা অংকের মাইনের লোভ, দেশ-বিদেশ সফরের চমকপ্রদ সুযোগ আর বাড়ি-গাড়ি’র স্বপ্নে বিভোর সদ্য রাজনীতি ও শিক্ষাজীবন সম্পন্ন হয়েছে, এমন তরুণদের কাছে এই সেক্টরটিই হয়ে উঠে জীবনের একমাত্র আরাধ্য।

রকমারি শিরোনামের প্রকল্প, চিত্তাকর্ষক কর্মশালা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-প্রশিক্ষণ আর নানা নামের ফেলোশীপ নিয়ে তরুণরা নেমে পড়লেন শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায়। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে একেবারে প্রান্তিক আর দুর্গম জনপদেও। শিক্ষা-সংস্কৃতি-ভাষা-কৃষি-স্বাস্থ্য-বন-স্যানিটেসন-সুপেয় পানি-নারী ও শিশু-পরিবেশ-প্রকৃতি থেকে শুরু করে এমন কোন বিষয় নেই, যা নিয়ে পাহাড়ের এনজিওগুলো কাজ করেন নি।

‘মানবাধিকার’-এর প্রশ্নটি তিন পার্বত্য জেলাতে কোন সময়ই প্রশ্নাতীত ছিল না। কিন্তু ‘জাতিসংঘ’ স্বীকৃত সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রশ্নটি এখানে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সাথে গলা মিলিয়ে বেশিরভাগ সময় এনজিওগুলো’র পক্ষ থেকেও একই সুরে উচ্চকন্ঠ হতে দেখা গেছে। ফলে, সর্বজনীন উন্নয়নের প্রশ্নটি বেশিরভাগ সময়ে ধামাচাপা পড়েছে রাজনৈতিকায়িত এনজিও চিন্তার কাছে। কখনো কখনো ‘অধিকারভিত্তিক’ ইস্যুকে সামনে রেখে কোন কোন এনজিও ব্যক্তিত্ব প্রদর্শন করেছেন এমন শক্তিমত্তা, যা আমাদের ‘জাতিরাষ্ট্র’ এবং প্রচলিত সার্বভৌম দেশীয় সম্মানবোধকেও উৎরে গেছে। এনজিও কী করতে পারে বা পারবে অথবা কী করা উচিত ও অনুচিত, এই প্রশ্নটির সীমানা ডিঙিয়ে এনজিও ব্যক্তিত্বরা ছুটেছেন সীমা লঙ্ঘনের পথেও।

তবুও, রাষ্ট্রের উদার বৈচিত্রময় বিকাশের ধারোকে পুষ্ট করার স্বার্থে অনেক সময় তা মান্য হিসেবেই দেখেছে। কিন্তু, সরকারের এই উদারতাকে অনেক সময় রাষ্ট্রের বৈরিপক্ষ হিসেবেই বেছে নিয়েছেন কোন কোন এনজিও। যা, পাহাড়ের চিহ্নিত কিছু এনজিও’র প্রকল্প বিশ্লেষণ এবং এসব এনজিও’র কর্ণধারদের পাসপোর্ট দেখলেই সহজে প্রতীয়মান হবে।

সে যাক, গত শনিবার (১৭ আগস্ট) রাঙামাটিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এক আঞ্চলিক সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি পার্বত্যাঞ্চলের এনজিও কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করেছেন ‘এনজিও যদি কাজে স্বচ্ছতা না থাকলে, গাট্টিগুট্টা বেঁধে চলে যান’। যা বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় গত শনিবার (১৮ আগস্ট) প্রচারিত হয়।
তাঁর সাথে সুর মিলিয়েছেন, সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও রাঙামাটির মাননীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার। এঁরা দুইজনই দেশের স্বৈরতন্ত্র উত্তর গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পাহাড়ের অন্যতম রাজনৈতিক ‘লিজেন্ড’। বাংলায় বললে তাঁদেরকে পাহাড় নয়, সমতলের তুলনায় ‘রাজনীতির বরপুত্র’-ই বলতে হয়। এই দুই ব্যক্তিত্বের সাথে পরম সহমত পোষণ করেছেন সভাটির অন্যতম অতিথি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার এবং রাঙামাটির জেলা প্রশাসকও।

বিষয়টি কোনভাবেই হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে তিন পার্বত্য জেলার জনপ্রতিনিধি এবং মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, তাঁদের চোখে যদি পার্বত্যাঞ্চলের এনজিও কার্যক্রমের দশা এই হয়, তাহলে সাধারণ্যের চোখে বিষয়টিকে ভয়াবহভাবেই দেখতে হয়। এবং আমি নিজেও তাঁদের সাথে অনেক ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করলেও বিষয়টি নিয়ে ভাবিত হতে বাধ্য হচ্ছি।

পাহাড়ে দুই দশকের বেশি সময় সংবাদকর্ম চর্চার পাশাপাশি প্রায় দীর্ঘ সময় আমি নিজেও এনজিও কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। দেশের প্রতিষ্ঠিত অন্তত: দুটি এনজিওতে কাজ করার সুবাদে এখানকার এনজিও কার্যক্রমকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। পাহাড়ের এনজিওগুলোর দেশি-বিদেশি ফান্ড সংগ্রহ-ব্যবস্থাপনা-নিয়োগ-উন্নয়ন কৌশল এবং নিজস্ব সম্পদ অর্জনের নীতি ও রক্ষনাবেক্ষণ, আমার বোঝার সুযোগ হয়েছে।
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া সম্ভব, অনেকগুলো এনজিও’র নিজস্ব সম্পদ অর্জনের পথে এখানকার স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে সরাসরি সরকারের অর্থও বিনিয়োগ হয়েছে কোন প্রকার বাধা ছাড়াই। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এনজিও অনেকটা পারিবারিক সম্পত্তিতেও পরিণত হয়েছে। ‘রাজনীতি ও স্বজন পরায়ণতা’র কথা যদি কেউ তুলেন, তাও উড়িয়ে দেয়া কঠিন হবে।

আর এসব প্রশ্ন মিলিয়েই এখানকার এনজিও কার্যক্রমকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগটি এনে দিচ্ছে। যেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলছেন সময়ের মেধাবী সন্তানরা!
না হয়, গত শনিবারের ভরা মজলিশে গণহারে এনজিও কার্যক্রমকে তুলোধুনো করার পরও কেনো এনজিও ব্যক্তিত্বরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। স্বার্থ আর সম্পদের নেশায় বুঁদ হয়ে গেলে তো কারো বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন তোলার আসলেই সুযোগ থাকে না।

আমাদের দেশে বেশিরভাগ এনজিও ‘রাষ্ট্র এবং প্রশাসন’-কে পরামর্শ দেন। সুশাসনের বুলি আওড়ান। গণতন্ত্র-স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার ছবক দেন। কিন্তু দেশের কয়টি এনজিও এসব নীতিকথা মেনে চলেন? পাহাড়ের এনজিওগুলি কী তাঁর উর্দ্ধে? পাহাড়ের এনজিও কার্যক্রমের একটি সারমর্ম দাঁড় করানো উচিত, এনজিওগুলোর পক্ষ থেকেই। কারণ, তাঁরা গত দুই দশকে যে পরিমাণ জরিপ-সমীক্ষা-গবেষণা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বদৌলতে অর্থ পেয়েছেন এবং ব্যয় করেছেন, তাতে খুব সহজেই জনসমক্ষে একটি চ্যালেঞ্জিং ধারণা উপস্থাপন করা সম্ভব। আর তা যদি সম্ভব হয় তাতেই পাহাড়ের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের কী-পার্সনদের ধারণা স্বচ্ছ করা সম্ভব।

এনজিও’র উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেও এক ধরনের ধোঁয়াশা অবস্থা বিরাজমান। যেমন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ তাঁদের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটি পরামর্শক দলের সভা করে থাকেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। একটি ইউনয়ন পরিষদও তাঁদের বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনায় তাঁর অংশীজনের মতামত নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাহাড়ের কয়টি এনজিও প্রকল্প পরিকল্পনায় অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন?

অথচ, তিন পার্বত্য জেলার বেশিরভাগ এনজিও’র-ই নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিত্বরা দেশি-বিদেশি জ্ঞানে ঋদ্ধ। যথেষ্ট পরিমাণ একাডেমিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান আছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ^াস। তাঁরা কী একবারও উন্নয়ন বোর্ডের গাভী পালন প্রকল্পের মতো জন আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে, এমন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছেন? অথবা এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকাঘনিষ্ঠ স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে পারেন না?
সরকার যা করছে অথবা সরকার যা করবে এবং করতে পারে, তাই যদি এনজিও’র ফরজ কাজ হয়ে থাকে তাহলে তো এনজিও কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। আর এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে এনজিও ব্যক্তিত্বদের চুপ করে থাকা ছাড়া আর কীই বা করণীয় থাকবে?

প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী।