প্রকাশঃ ১৬ জুনe, ২০১৯ ১০:০৩:৫৪
| আপডেটঃ ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ০২:২১:২১
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় মা দিবস। দিবস এলে সবাই মাকে নিয়ে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়। আমিও একজন সৌভাগ্যবান মানুষ হিসেবে মায়ের উপস্থিতিকে উপভোগ করতে প্রতিদিন ২-৩ বার, কখনো ৫-৬বারও ফোনে কথা বলি। মায়ের দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলোর খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি। নিজের সামর্থের মধ্যে হলে দেয়ার চেষ্টা করি। না পারলে সময় চেয়ে রাখি।
ভাই বোন মিলে বাবাদের পরিবার বেশ বড় হলেও সবাই দাদা-দাদীর খোঁজ খবর নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। ব্যতিক্রম হিসেবে শুধু বাবাকে দেখেছি। প্রয়োজনে নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যরে মধ্যে সব সময় পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। দাদা-দাদীর এক নাতি পাবলিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন। মারমা ছাত্রছাত্রীদের জন্য যা বিরল। কিন্তু খবরটি দাদা-দাদীর জীবদ্দশায় জানতে পেরেছিলেন কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এটি শুধু আমাদের আত্বীয়-স্বজনদের চিত্র নয়। সেই সময়ে কিছু নব্য শিক্ষিত মারমাদের চিন্তা চেতনার একটি অংশও বটে।
পাহাড়ে পিতা মাতারা শত প্রতিকুলতার মাঝেও পড়ালেখা করানোর চেষ্টাগুলোকে, খুব কম সন্তানেরাই উপলব্ধি করতে পারি। এই সম্পর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি গল্পও আছে। পড়ালেখা জানা এক ছেলের বাড়িতে পিতা বেড়াতে গেলে জীর্ণ শরীর নিয়ে বসে থাকা মানুষটির পরিচয় জানতে চাইলে (ছেলের বন্ধুরা) নাকি ইংরেজিতে সার্ভেন্ট বলেছিলেন। সাংঘাতিক ব্যাপার!
যদিও সময়ের পরিবর্তনে তরুণদের মাঝে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে ভাল লাগছে। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা খাগড়াছড়ির এক মারমা ছেলের কথা জানি; যে নির্দ্বিধায় প্রসঙ্গ উঠলে, মা-বাবা’র দিনমজুরীর পয়সায় তার পড়ালেখা কথা বলেন। বর্তমানে ছেলেটি পড়ালেখা শেষ করে ‘যেনতেন’ একটি কাজ যোগাড় করে বাবা- মাকে একটু অবসর দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। খুব সম্প্রতি মাকে বিমানে চড়ানোর ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস ও দিয়েছেন।
সময় পেলে মাঝে মধ্যে বেঙ্গল লাইব্রেরিতে যাই। দেশে এখন লাইব্রেরি’র ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। বই পড়ার সময় কম থাকলেও উল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে খুব ভাল লাগলে, দুই একটি কদাচিৎ বই কিনে আনি। একদিন সেখানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক ছেলে পাশে বসে বললেন ‘মামা আমাকে চিনতে পারছেন? আমি কিন্তু আপনাকে চিনি’। খুব ছোট থাকতে যাদের দেখেছি কিংবা যাদের সাথে গ্রামে বেড়ে উঠতে গিয়ে নানা প্রক্রিয়ায় দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের ছেলেমেয়েদের চেনা একটু কঠিনই বটে। তাই সরাসরি বলে ফেলি ‘না, চিনতে পারছি না’। ছেলেটি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তার বাবা একসময় অন্যের বাড়িতে থেকে কাজ করতেন তা স্মরণ করে দিলেন। মুহুর্তে ছেলেটির প্রতি আমার অগাধ ভালবাসার জন্ম হলো। বললাম ‘আজ চা খাওয়াবো। আগামীতে যেখানে দেখা পাবো চা খাওয়াতে বাধ্য থাকবো। তোমার সততা, মা বাবার প্রতি ভালবাসার জন্য’।
মা বাবা যদি দিনমজুরি করতেন, খেটে খাওয়া মানুষ হতেন, আমার বড় ভাই বোন, ছোট ভাইবোনেরা আদৌ এদের মতো করে গর্ব নিয়ে পরিচয় দিতেন কিনা জানি না। আমার ভাইবোনেরা নিঃসন্দেহে সৎ, ভাল মানুষ। কিন্তু মা বাবার প্রতি আমরা আদৌ যতœশীল হতে পেরেছি কিনা প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমার শত ব্যস্ততা থাকলেও বাবা মাকে ঠিকই খবর নিই। পকেটে কিছু থাকলে তাদের দিতে পারলে ভাল লাগে। নিজে ভাল কিছু খেতে বসলে তাদের কথাই মনে আসে আগে। প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে এক মিনিট তাদের জন্য প্রার্থনা না করে কোনদিন ঘুমোতে যাই না। তাদের জন্য প্রার্থনার পাশাপাশি সকল ভাইবোন, আতœীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবদেরও আমার পূণ্যের ভাগ দিই। তারা সেটা পাবে কিনা জানি না। তবে মা-বাবা, ভাইবোনদের পাশাপাশি পরিচিতজনদের জন্যও প্রতিদিন একমিনিট সময় ব্যয় করে ভাল কিছু প্রত্যাশা করার মধ্যে ক্ষতি তো নেই।
প্রত্যেক অভিভাবকের ন্যায়, আমার মা-বাবাও আমাদের জন্য সীমাহীন কষ্ট করেছেন ( মা ও বাবাকে নিয়ে প্রকাশিত তিনটি লেখায় তার সামন্য কিছু উল্লেখ করা চেষ্টা করেছি)। তাদের নিয়ে অল্প কিছু দেশ ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। আমার দ্বারা আগামীতে আদৌ এ স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা জানি না। কয়েক বছর আগে তাদের জন্য পাসপোর্ট করে দিয়ে ভাইবোনদের উদ্যোগ নিতে বলেছিলাম। কিন্তু বাবার অনাগ্রহের অজুহাতে কেউ আর এগুইনি। এই মুহুর্তে আমার একার সামর্থ্য নেই। কিন্তু স্বপ্ন দেখি আমি তাদের পছন্দের কিছু দেশে নিয়ে যেতে পেরেছি।
আরও একটি স্বপ্ন দেখি। প্রতি মাসে অন্তত একবার বড় ডাক্তার দ্বারা চেকআপ করাতে পারছি। আমার জীবনে এই দুটি কাজ করতে পারলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবানদের একজন ভাববো।
সম্প্রতি পাহাড়ের এক কৃতি ছাত্রী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষিকার আপন বড় ভাই নিজেদের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তাদের মা জুমচাষ করতেন আর বাবা কোন এক অফিসে মাস্টার রুলে কাজ করতেন বলে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া খবরের চেয়ে তাদের মাকে একজন জুমচাষি হিসেবে পরিচয় দেয়াকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং মায়ের জন্য এটি আনন্দের ও গর্বের বলে মনে হয়েছে।
পাহাড় সমাজে কিছু তরুণদের মধ্যে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতেও লজ্জাবোধ দেখা গেলেও এক শ্রেণি তরুণদের মাঝে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ছে। এই তরুণরাই হতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস। আপনার আমার যা আছে তা নিয়েই গর্ব করতে হবে। ‘এড়া’কে মাংস বললে ভাষা বাঁচানোর চিন্তা করা হবে ভুল। নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসাবোধ নিয়ে চর্চা করাও হতে পারে মায়ের প্রতি ভালবাসার একটি ভাল উদাহরণ।
পাহাড়ে অনেক অনেক পরিবার পাওয়া যাবে যাদের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষিত, ভাল চাকরিজীবি কিন্তু অন্য দশ জনের সামনে মায়ের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পান। নিত্যদিন কোন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা ব্যবহারকে ‘সমাজে এলিট পরিবারের সংস্কৃতি’ ইত্যাদি মনে করেন। আমার মতে, পাহাড়ে সেরা মা, সেরা পিতা মাতা, তারাই যাদের সন্তানেরা মায়ের ভাষায় কথা বলেন, চর্চা করেন, পিতা মাতার পেশাগত পরিচয় জুমচাষি, খেটে খাওয়া মানুষ হলেও গর্ব নিয়ে পরিচয় প্রদান করেন।
আসুন, আমাদের মা-বাবা যে পেশায় নিয়োজিত থাকুক না কেন আমরা যেন গর্ব করে বলতে কখনো ভুল না করি। আমার মনে হয় সেটিই হবে মা-বাবার প্রতি সেরা ভালবাসা, সেরা উপহার। আর সন্তান হিসেবে আমরাও এমন কোন কাজ না করি যে কারণে পিতামাতাকে কোথাও কখনো বিব্রত হতে হয়।
লেখক: উন্নয়নকর্মী। ইমেইল:
nmong7@yahoo.com