তিন পার্বত্য জেলায় সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী যারা

প্রকাশঃ ২৪ জানুয়ারী, ২০১৯ ০৫:৫৬:০২ | আপডেটঃ ১৮ মার্চ, ২০২৪ ০১:৩১:১৮
সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। পাহাড়ের তিন জেলার জন্য সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য পদে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ১৭ জনের মধ্যে অধিকাংশই দলে নবাগত এবং দল ও সরকারের পদ-পদবীতে ভরপুর। হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ প্রার্থীই নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেই দলে যোগ দেয়া। টানা দুই মেয়াদে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তাঁরা সরকারি পদ-পদবী ছাড়াও মালিক বনেছেন বিপুল বিত্ত বৈভবের।

তিন পার্বত্য জেলার জন্য জাতীয় সংসদে মহিলা সংরক্ষিত ৫০ নং আসনে লড়াইয়ে নেমেছেন সর্বমোট ১৭ জন নারী। এরমধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ৭ জন। এঁরা হলেন খাগড়াছড়ি জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী ও জেলা মহিলা সংস্থা’র চেয়ারম্যান ক্রইসাঞো চৌধুরী, মানিকছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামীলীগের নির্বাহী সদস্য শাহিনা আক্তার, পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য নিগাড় সুলতানা, খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও পার্বত্য জেলা পরিষদের নারী সদস্য শতরুপা চাকমা, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট-এর ট্রাস্টি ও মহিলা আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য বাসন্তি চাকমা, সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য অন্তরা খীসা এবং দলের নেতাকর্মীদের কাছে স্বল্প পরিচিত শ্রেয়ন্তী ত্রিপুরা রয়েছেন। খাগড়াছড়ি জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী ও জেলা মহিলা সংস্থা’র চেয়ারম্যান ক্রইসাঞো চৌধুরী, শাহিনা আক্তার ও নিগাড় সুলতানা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

বান্দরবান জেলা থেকে ৪ জনের মধ্যে সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের নির্বাহী সদস্য সুচিত্রা তঞ্চগ্যা, জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি জাহানারা আরজু, বর্তমান সভাপতি জহুরা বেগম এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি উজিতা বেগম রোজী। এরমধ্যে সুচিত্রা তঞ্চংগ্যা দশম জাতীয় সংসদে দলের চুড়ান্ত মনোনয়ন পেলেও স্থানীয় আওয়ামীলীগের আপত্তির মুখে তিনি এমপি হতে পারেননি বলে অভিযোগ আছে।

রাঙামাটি জেলা থেকে ফিরোজা বেগম চিনু ছাড়াও গুমের শিকার রাঙামাটি জেলার প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা ও ওয়া¹া ইউপি’র দুই বারের চেয়ারম্যান অনিল তঞ্চগ্যার বিধবা স্ত্রী ও জেলা পরিষদ সদস্য শান্তনা চাকমা, রাঙামাটি জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিতা দেওয়ান, জেলা মহিলা যুবলীগের সভাপতি শিক্ষিকা রোকেয়া আক্তার, সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক লেখিকা চাকমা এবং ফারজানা আক্তার রয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে রাঙামাটি জেলা থেকে সাবেক এমপি ফিরোজা বেগম চিনু’র সাথে শান্তনা চাকমাকে শক্ত প্রতিদ্বন্ধী মনে করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে রাঙামাটির সাধারণ নেতাকর্মীরা জানান, শান্তনা চাকমা’র স্বামী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মূলত: একটি প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ থাকার কারণেই তাঁকে অকালে গুমের শিকার হতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সংসদের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু এবারও সরকারি দলের অন্যতম মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে মহিলা আওয়ামীলীগ-এর কেন্দ্রীয় দুই নির্বাহী সদস্য ছাড়াও তিন জেলার জেলা-উপজেলা এবং এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের নেত্রীও দলের মনোনয়ন কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তবে এরমধ্যে বেশিরভাগ মনোনয়ন প্রত্যাশীই আওয়ামী রাজনীতিতে সুসময়ের পাখি এবং বর্তমান সরকারের টানা দুই মেয়াদে পদ-পদবী এবং সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অনেকটা ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’র মতো প্রাপ্তি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে দলের নেতা কর্মীরা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এখন তাঁরা দলের পুরনো দু:সময়ের পরীক্ষিত নেত্রীদের ছাপিয়ে এগিয়ে চলেছেন সুসময়ের পাখিরাই।

দেশ স্বাধীনের পর থেকে বিভিন্ন সরকারের সময় রাঙামাটি ও বান্দরবান থেকে সংরক্ষিত নারী কোটায় বেশ কয়েকজন জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলেও এখন পর্যন্ত খাগড়াছড়ি জেলা থেকে কেউ-ই নারী সংসদ সদস্য হবার সুযোগ পাননি। দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র শাসনামলে রাঙামাটি থেকে সুদীপ্তা দেওয়ান, জিয়াউর রহমানের আমলে মন্ত্রী মর্যাদায় রাজমাতা বিনীতা রায় রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা, এরশাদ সরকারের আমলে মালতী রানী তঞ্চংগ্যা এবং বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে ফিরোজা বেগম চিনু সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য হয়েছেন। বিএনপি সরকারের আমলে বান্দরবান থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা মিসেস ম্যামাচিংও এক মেয়াদে নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর থেকে এখন পর্যন্ত খাগড়াছড়ি জেলা থেকে সংরক্ষিত নারী কোটায় সংসদে যাবার সন্মান অর্জন করতে পারেননি। ফলে সেই সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে লড়াইয়ে নেমেছেন দলের পুরনো-নতুন এবং অচেনা মুখও।

রাঙামাটির সাবেক এমপি ফিরোজা বেগম চিনু জানান, তিন যুগের অধিক  সময় আওয়ামীলীগের সাথে কাটিয়েছেন। আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। তবে পাহাড়ি-বাঙালির শান্তিপূর্ন সহাবস্থান নিশ্চিত করতে কখনো পিছপা হননি। বর্তমানে তিনি আবারো প্রার্থী হয়েছেন- মহিলা সংরক্ষিত আসনে এমপি হতে। এজন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

শান্তনা চাকমা জানান, তাঁর স্বামী কাপ্তাই উজেলার ওয়া¹া ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান অনিল তঞ্চগ্যা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাঙামাটির আওয়ামী রাজনীতিতে দু:সময়েও দু:সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। তাই তিনি দুর্বৃত্তদের হাতে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন।

খাগড়াছড়ি থেকে সংরক্ষিত আসনে এমপি পদ প্রত্যাশীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মহিলা লীগের সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা মহিলালীগের সাধারণ সম্পাদিক শাহিনা আক্তার জানান, আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থাশীল। তিনিই পাহাড়ে শান্তির জন্য পাহাড়ি-বাঙালি সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করেছেন। দলের দু:সময়ে আমি কাজ করেছি। তিনি যাঁকেই যোগ্য মনে করবেন, আমি তাঁর নেতৃত্বেই অনুগামী হবো।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শতরূপা চাকমা বলেন, খাগড়াছড়িবাসী মানুষ আমাকে চায়। পাহড়ের সকল সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করাসহ নারীদের অগ্রধিকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি কাজ করবো।

বাসন্তি চাকমা জানান, তিন পার্বত্য জেলায় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে খাগড়াছড়ি জেলার নারীরা নানাক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। এ অঞ্চলের নারী সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য খাগড়াছড়ি থেকে সংরক্ষিত আসনে নেতৃত্বের দাবি খাগড়াছড়িবাসীর।

খাগড়াছড়ির মনোনয়ন প্রত্যাাশী বাসন্তি চাকমা নিজের মনোনয়নের ব্যাপারে শত ভাগ আশাবাদী দাবী করে বলেন, বিগত দিনে খাগড়াছড়িকে নারী আসন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ কারণে খাগড়াছড়ির নারীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। সংরক্ষিত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে পাহাড়ে নারী শিক্ষায়নে বিশেষ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি অবহেলিত ও বঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থানে উদ্যোগ নিবেন বলে জানান।

তবে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দাবি, নির্বাচিত তিনজন সংসদ সদস্য, পার্বত্য মন্ত্রনালয়, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পাহাড়ী হওয়ায় সংরক্ষিত আসনে যেন বাঙালী নেত্রীদের দেয়া হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িক সমতা আসবে।
এদিকে গত ১৫ জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন পত্র বিক্রি শুরু করেছে, তফসিল ঘোষনার আগ পর্যন্ত মনোনয়ন পত্র বিক্রি করবে দলটি।

বাংলাদেশের ৩৫০  আসনের সংসদে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। ৩০০ আসনে সরাসরি ভোট হলেও সংরক্ষিত আসন বণ্টন হয় ভোটে জয়ী দলগুলোর আসন সংখ্যার অনুপাতে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে এবার আওয়ামী লীগ ৪৩টি, জাতীয় পার্টি ৪টি, বিএনপি ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোটভুক্ত হয়ে ১টি সংরক্ষিত আসন পেতে পারে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে জানিয়েছে, আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।