প্রকাশঃ ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০৬:১০:০৫
| আপডেটঃ ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ ০২:৩২:১৩
হিমেল চাকমা, বিশেষ প্রতিনিধি, রাঙামাটি। প্রচারণায় সর্বশেষ পর্যন্ত এগিয়ে আছে নৌকা মার্কা। তবে প্রচারণা ছাড়া জয়ের পাল্লা ঝুঁকে গেছে সিংহের দিকে! এদিকে প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থেকে পিছিয়ে পড়েছে ধানের শীষ। এ অবস্থায় সরগরম রাঙামাটির নির্বাচনী মাঠ।
সোমবার মার্কা পাওয়ার পর প্রচারণা শুরু করেছেন রাঙামাটি আসনের প্রার্থীরা। নৌকা মার্কা পেয়েছেন দীপংকর তালুকদার। ধানের শীষ মনি স্বপন দেওয়ান। সিংহ মার্কা উষাতন তালুকদার। লাঙ্গল মার্কা মো.পারভেজ তালুকদার। কোদাল মার্কা নিয়ে জুই চাকমা এবং হাত পাখা মার্কা পেয়েছেন মো. জসিম উদ্দিন। সব প্রার্থী জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। তবে সাধারণ ভোটাররা মাতামাতি করেন শুধু তিনটি মার্কা নিয়ে। এগুলো হল; নৌকা সিংহ এবং ধানের শীষ।
প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে ইউপিডিএফের শান্তি দেব চাকমা ও সচিব চাকমা, বিএনপির এড.দীপেন দেওয়ান এবং জেএসএসের বিকল্প প্রার্থী শরৎ জ্যোতি চাকমা প্রার্থীতা প্রত্যাহারের পর নির্বাচনী হিসাব পুরোপুরি বদলে গেছে এ আসনের। ইউপিডিএফ তাদের সব প্রার্থী প্রত্যাহার করায় শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে সতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ উষাতন তালুকদার।
প্রচারণায় এগিয়ে আওয়ামীলীগ;
মার্কা নির্ধারণ থাকায় তফসিল ঘোষণার আগে থেকে প্রচারণায় ছিল আওয়ামীলীগ। এটি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে রাস্তা-ঘাটে, মাঠে-ময়দান পেরিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। তবুও পরাজয় আশংকা নেতাকর্মীদের মনে। কঠিন প্রতিপক্ষ হওয়ায় সুখে নেই কেউ।
উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছেন সবখানে। দাবী তুলছেন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের কথা। গতবার ভোট কম পাওয়া ৫২ টি কেন্দ্রে বিশেষ নিরাপত্তা চান দীপংকর তালুকদার। দীপংকরের অভিযোগ এলাকাগুলো অবৈধ অস্ত্রধারীদের আনাগোনা আছে।
তালুকদারের এসব কথায় রীতিমত ক্ষুব্ধ ঐসব এলাকার সাধারণ ভোটাররা। তারা বলছেন, এলাকা সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করে এলাকার সুনাম নষ্ট করা হচ্ছে। ব্যাক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে এলাকার সুনাম নষ্ট করা হচ্ছে। অভিযানের নামে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে।
৫২টি কেন্দ্রের মধ্যে রাঙামাটি শহরের রাঙাপানী গ্রামের যোগেন্দ্র দেওয়ান পাড়া কেন্দ্রটিও রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও রাঙামাটি সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পলাশ কুসুম চাকমা বলেন, এ গ্রামে বিভিন্ন শ্রেণীর বসবাস করে। এর মধ্যে সরকারী বেসরকারী চাকুরীজীবী আছে। আওয়ামীলীগ আছে, বিএনপি আছে, জেএসএস আছে। আওয়ামীলীগ এ কেন্দ্রে ভোট কম পায় বলে এ এলাকা নিয়ে অপপ্রচার করা ঠিক নয়। অপ প্রচার না করে অপপ্রচারকারীদের উচিত ভালবাসা দিয়ে এ এলাকার মানুষের মন জয় করা। তা না করে এলাকায় অবৈধ অস্ত্রধারী থাকে এসব মনগড়া কথা বার্তায় এলাকায় সুনাম নষ্ট করা হচ্ছে। এসব কথাবার্তার কারণে নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের দিন রাত পাহারা দেয়। আমরা এখন সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা-রাতে বৈধ অস্ত্র দেখি। অবৈধ অস্ত্র দেখি না। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের নামে এলাকায় মানুষদের হয়রানী করা হচ্ছে।
জয়ের পাল্লা ঝুঁকেছে জেএসএসের দিকে:
কোন প্রচারণা নেই। শেষ ভাল যার সব ভাল তার এ নীতিতে এগুচ্ছে জেএসএস। বিএনপি দীপেন দেওয়ানকে মনোনয়ন না দেওয়া আর ইউপিডিএফ তাদের প্রার্থী তুলে নেওয়ায় দুটি বোনাস পয়েন্ট পয়েছে জেএসএস। কারণ দীপেন দেওয়ান জেএসএসের কিছু ভোট মাইনাস করে নিজের বাক্সে নিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে ইউপিডিএফের দুজন প্রার্থী প্রার্থীতা প্রত্যাহার করায় জেএসএসের বাক্সে যাচ্ছে তা অনেকটা নিশ্চিত বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউপিডিএফের ভোটগুলো আওয়ামীলীগ না পাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে জেএসএস এমএন লারমা দলের সাথে দা-কুমড়ার সম্পর্ক ইউপিডিএফের। কিন্তু এ এমএন লারমা দলের সাথে বর্তমান আওয়ামীলীগের সম্পর্ক ভাল। তাই ইউপিডিএফ চাচ্ছে না আওয়ামীলীগ প্রার্থীর বিজয়ী হোক। বিজয় ঠেকাতে ইউপিডিএফ জেএসএসকে সমর্থন দেবে তা শুধু সময়ের ব্যাপার বলছে উভয় দলের সূত্রগুলো। যদিও ইউপিডিএফ শেষ পর্যায়ে কাকে সমর্থন দিচ্ছে বা দেবে তা ঘোষণা দেয়নি।
দেড় বছরের অধিক সময় বড় দুটি আঞ্চলিক দল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে সমঝোতার রাজনীতির কর্মকান্ড করে যাচ্ছে। এর মাঝে জেএসএস এম এন লারমা ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ মুল ইউপিডিএফের সাথে বিরোধ জড়ালেও ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক অটুট রেখে চলেছে মুল ইউপিডিএফ ও মুল জেএসএস। এমন অবস্থায় জয়ের সম্ভাবনা বেশী স্বতন্ত্র প্রার্থী উষাতনের।
সিংহতে এক, বড় দুই আঞ্চলিক দল:
খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু জেএসএস দেয়নি। রাঙামাটিতে জেএসএস প্রার্থী দিয়েছে। ইউপিডিএফ দেয়নি। দুই জেলায় দুই প্রার্থীর মার্কা সিংহ। এ সিংহতে এক হয়েছে দল দুটি। খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষীছড়ি, মানিকছড়ি, দিঘিনালা উপজেলায় জেএসএসের অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে রাঙামাটি জেলায় নানিয়াচর, কাউখালী উপজেলা ছাড়াও রাঙামাটি সদর, বাঘাইছড়ি, লংগদু উপজেলার কিছু অংশ ইউপিডিএফের অবস্থান থাকায় নিজেদের প্রার্থী না থাকায় মিত্র পক্ষের হয়ে ভোট যুদ্ধে সহায়তা করবে। এটি কোন দল ঘোষণা না দিলেও অলিখিত সমঝোতা হয়ে গেছে জানা সংশ্লিষ্টসূত্রগুলো থেকে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে গেছে বিএনপি:
দলীয় কোন্দল। এরপর প্রার্থী নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত। এসব কারণে ভোট যুদ্ধে পিছিয়ে পড়েছে বিএনপি। ১৭ বছর আগের হিসাব করে মনি স্বপনকে প্রার্থী দেওয়ায় বড় ভুলটি করে বিএনপি। গুজব ছড়ানো হয় মনি স্বপনকে জেএসএস বা পাহাড়িরা সমর্থন দিয়েছে। এমন অবস্থায় বিএনপির ভোটগুলো পেলে মনি স্বপন আবারো ২০০১ সালের ন্যায় বিজয়ী হবে। কিন্তু নির্বাচনী মাঠে বর্তমান এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উষাতন যে আছে তা ভুলে গিয়েছিল বিএনপি। ২০০১ সালে উষাতনের জেএসএস নির্বাচন বর্জন করা ও পরোক্ষভাবে মনি স্বপনকে সমর্থন করায় সেবার জিতেছিল বিএনপি। এবার সমর্থনের পরিবর্তে উল্টো বিএনপির ভোটও মাইনাস করে জেএসএস নিজেদের বাক্সে নেবে এ আশংকা উড়িয়ে দিচ্ছে না কেউই। তা যদি হয় তাহলে তৃতীয় অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে বিএনপিকে। তবে এ থেকে উত্তোরণের জন্য কাজ করছে বিএনপি।
বিগত চার নির্বাচনী ফলাফল:
১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের কাছে পরাজিত হয় বিএনপি প্রার্থী পারিজাত কুসুম চাকমা।
এ নির্বাচনে দীপংকরের নৌকা প্রতীকের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৩ হাজার ১শ ১টি এবং পারিজাত কুসুমের ধানের শীষ প্রতীকের ৩৮ হাজার ৪শ ৯টি।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনি স্বপন দেওয়ানের কাছে পরাজিত হয় আওয়ামীলীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। মনি স্বপনের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৮হাজার ৭৪৪ টি, দীপংকরের ৫১ হাজার।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে দীপংকর তালুকদার বিএনপির প্রার্থী মৈত্রী চাকমাকে পরাজিত করে। এতে দীপংকরের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১ লাখ ১৫হাজার ১২টি। মৈত্রী চাকমার ৫৬,৪২৯ টি এবং তৃতীয় হওয়া জেএসএস প্রার্থী উষাতন তালুকদারের ভোট ছিল ৫১,৮৩৩টি।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে জেএসএস প্রার্থী উষাতন তালুকদারের কাছে পরাজিত হয় দীপংকর তালুকদার। এতে উষাতনের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯৬,২৩৭ টি এবং দীপংকরের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৭৭,৩৮৫টি।