পাহাড়ে ৬ মাসে ১১ খুন !

প্রকাশঃ ২০ মে, ২০২৪ ০৪:৪৬:৫০ | আপডেটঃ ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৭:৪৮:০১
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। আড়াই মাস পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে খুনোখুনির খবর পাওয়া না গেলেও ফের রক্তাক্ত হলো সবুজ পাহাড়। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকালীন সময়ের মধ্যে আঞ্চলিক দলের নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা, পাল্টাপাল্টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ি জনপদে। সর্বশেষ শনিবার (১৮ মে) রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এক কর্মীসহ দুজনকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্ত।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে বিগত ছয়মাসে রাঙামাটি-খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের ১১ নেতাকর্মী-সমর্থককে প্রাণ হারাতে হয়েছে দুর্বৃত্তের গুলিতে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের অনিলপাড়ায় গুলি করে ইউপিডিএফের চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ওই সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহসভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন ত্রিপুরা।

পানছড়ির চার খুনের দেড় মাসের মাথায় গত ২৪ জানুয়ারি জেলার মহালছড়ি উপজেলায় আরও দুজনকে হত্যা করা হয়। তখন মারা যান ইউপিডিএফ সদস্য রবি কুমার চাকমা ও শান্ত চাকমা ওরফে বিমল। ৪ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় আরও দুজন খুন হলেন; নিহত হন ইউপিডিএফ সদস্য দীপায়ন চাকমা ও আশুক্য চাকমা ওরফে আশীষ। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে একই উপজেলা বঙ্গলতলী ইউনিয়নে ঘাতকের বুলেটে খুন হলেন ইউপিডিএফ কর্মী নিপন চাকমা। সর্বশেষ শনিবার (১৮ মে) রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় বিদ্যাধন চাকমা এবং ধন্য মনি চাকমা নামের দুইজন মারা যান। এ নিয়ে ছয় মাসের মধ্যেই খাগড়াছড়িতে ৬ ও রাঙামাটিতে ৫ কর্মীসহ ইউপিডিএফের ১১ নেতাকর্মী প্রাণ হারান।

এসব হত্যাকা-ের ঘটনায় পাহাড়ে বিবাদমান আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-কে দায়ী করে আসছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। তবে তিনটি সংগঠনই এসব হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

সর্বশেষ লংগদুতে ডাবল মার্ডারের ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত’ ও ‘ন্যাক্কারজনক’ মন্তব্য করে ইউপিডিএফের রাঙামাটি ইউনিটের সংগঠক সচল চাকমা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ইউপিডিএফের নেতৃত্বে সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০ (পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালা) বাতিলের ষড়যন্ত্রসহ বান্দরবানে বম জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করার লক্ষে এবং সরকারের কৃপা লাভের আশায় সন্তু লারমা আবারো তার খুনি বাহিনীকে দিয়ে ইউপিডিএফের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হত্যাকা- শুরু করেছেন।’

পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ক্রমশ ‘মিত্র হারাচ্ছে’ প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই ইউপিডিএফ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাহাড়ের রাজনীতিকে ধীরে ধীরে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠা এই সংগঠনটি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে ‘নিঃসঙ্গ’ হয়ে পড়েছে। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফের সঙ্গে জেএসএসের ‘অঘোষিত ঐক্যের’ মধ্যেই লংগদুর ডাবল মার্ডার কী বার্তা দিচ্ছেÑ সেই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে।

ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘পাহাড়ের নির্বাচনগুলোতে পার্টির অবস্থান থাকে। এবারও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে পার্টি। আমরা বিভিন্ন উপজেলায় জেএসএসের সমর্থিত প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমরা জেএসএসকে সমর্থন দিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মতার্দশিক বিরোধ আগের মতো রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বা বৃহত্তর ঐক্যের স¦ার্থে পার্টি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। যাতে করে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতসহ অন্যান্য সমস্যাবলির সমাধান আসে।’

নতুন খুনে ভেসে উঠে পুরনো স্মৃতি:
২০১৯ সালের ১৮ মার্চ (সোমবার) পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালেট পেপার, সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে নির্বাচনি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ভোটগ্রহণ কাজে নিয়োজিতসহ মোট আটজনের মৃত্যু হয়।

এ হামলার ঘটনায় পাহাড়ের তিনটি আঞ্চলিক দলটি তখন একে-অপরকে ঘটনার জন্য দোষারোপ করেছিল। এবারের ভোটেও বাঘাইছড়ি উপজেলায় পাহাড়ের বিবাদমান চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল দ্বি-পাক্ষিক অবস্থান নিয়েছে। এরমধ্যে জেএসএস-ইউপিডিএফ একটি পক্ষ এবং জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আরেকটি পক্ষে রয়েছে। দৃশ্যত দুই গ্রুপে চারদলে বিভক্ত পাহাড়ের আঞ্চলিক দলসমূহ।

এবারের উপজেলা পরিষদ তথা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বাঘাইছড়িসহ অন্যান্য উপজেলায় ভোট ঘিরে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নে দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র শাখার মধ্যকার পাল্টাপাল্টি গুলি বর্ষণের খবরও পাওয়া গেছে। শনিবার (১৮ মে) রাঙামাটির লংগদুতে দুর্বৃত্তের খুন হলেন ইউপিডিএফের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দুজন। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে; আরও আতঙ্ক বাড়ছে পাহাড়ে।

নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে রাঙামাটির চারটি উপজেলায় অত্যন্ত নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটেও যেন এমন পরিবেশ বজায় থাকে সেজন্য আমরা বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছি। নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা আশা করছি এবারের ভোটে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সজাগ-সচেতন রয়েছে কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যাতে বিঘিœত না হয়। গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’