রাঙামাটির একমাত্র উন্মুক্ত ডিসিপার্কটিও বাণিজ্যিক হচ্ছে ?

প্রকাশঃ ২৪ মার্চ, ২০২৪ ১০:০৯:১৩ | আপডেটঃ ০৯ মে, ২০২৪ ০৮:২৫:৫৫
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। কাপ্তাই হ্রদ আর পাহাড়ে ঘেরা পর্যটন শহর রাঙামাটি। বিশালাকার জলাধারের কাপ্তাই হ্রদ একদিকে রাঙামাটির যেমন অপরূপ সৌন্দর্য বাড়িয়েছে আবার হ্রদই রাঙামাটিতে দুর্গম করেছে। পার্বত্য শহর রাঙামাটির পর্যটনশিল্পে আমূল পরিবর্তন না হলেও বিগত এক দশকে গড়ে ওঠেছে ছোট-বড় বাণিজ্যিক পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র। হ্রদ পাহাড়ের শহর রাঙামাটির বাণিজ্যিক আয়োজনের বাহিরে এখনো পর্যন্ত একমাত্র উন্মুক্ত পার্ক রয়েছে শহরের ডিসি বাংলো পার্ক। এখন সেটিও বাণিজ্যিকভাবে চালুর দিকে হাঁটতে প্রশাসন। জেলা শহরের মানুষের আপত্তি রয়েছে পার্কটির বাণিজ্যিকরণ ঘিরে।

স্থানীয়রা বলছেন, রাঙামাটি জেলা শহরের শেষপ্রান্ত জিরো পয়েন্টে অবস্থিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) বাংলোর সামনের অবস্থিত পার্কটি পুরো শহরের মানুষের চিত্ত বিনোদন, খোলামেলা পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো এবং কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য উন্মুক্ত স্থান। আশপাশের বাসিন্দারাও পরিবার এবং শিশুদের নিয়ে বিকালের অবসর সময় কাটাতে আসেন। একে-একে সব উন্মুক্ত স্থানে পার্ক ও বাণিজ্যিকভাবে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে ওঠায় শহরের মানুষের যাওয়ার জায়গা নেই।

স¤প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, ডিসি বাংলো পার্কের সামনে আগে যেখানে গাড়ি ও মোটরসাইকেল পার্কিং করা হতো সেখানে একটি প্রবেশ বুথ তৈরি করা হয়েছে। প্রবেশ বুথের দেওয়ালে একটা নোটিস দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা আছে, 'পার্কের উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় পর্যটকগণের জন্য যাতায়াত সাময়িকবন্ধ'। তবে পার্কের ভেতরেও বেশকিছু পর্যটককে দেখা গেছে। এসময় কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানালেন, আগামীতে পার্কে ঢুকতে টিকেট লাগবে, সেজন্য তারা আপাতত কিছুদিন টিকিট ফি ছাড়াই ঘুরার সুযোগ পাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, রাঙামাটি জেলা শহরে পর্যটন করপোরেশনের ঝুলন্ত সেতু পার্ক, জেলা পুলিশের পলওয়েল পার্ক, জেলা প্রশাসনের শিশু পার্ক, সেনাবাহিনীর আরণ্যক, ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বার্গী লেকভ্যালি, বরগাঙ, রাঙাদ্বীপ এবং কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত বিজিবির ওয়াগ্গাছড়া রিভারভিউ পার্ক, সেনাবাহিনীর লেকশোর, নৌবাহিনীর লেকভিউ পিকনিট স্পষ্ট, বন বিভাগের প্রশান্তি পার্কসহ একাধিক পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র রয়েছে। এসব বিনোকেন্দ্রকেন্দ্র ও পার্কগুলো বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠায় পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও প্রবেশ করতে হয় প্রবেশমূল্য দিয়ে।

এরমধ্যে জেলা শহরের পর্যটন ঝুলন্ত সেতু পার্কে ২০ টাকা, পলওয়েল পার্কে ৪০ টাকা, শিশু পার্কে ২০ টাকা, আরণ্যকে ৪০ টাকা, বার্গী লেকভ্যালিতে ২০ টাকা, বরগাঙে ২০ টাকা, রাঙাদ্বীপে ৫০ টাকা, কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গাছড়া রিভারভিউ পার্ক ২০ টাকা, লেকভিউতে ২০ টাকা ও লেকশোর পিকনিটে ২০ টাকা, প্রশান্তি পার্কে ১০ টাকা প্রবেশ ফি দিতে হচ্ছে। কেবলমাত্র ডিসি বাংলো পার্কটিই আছে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। সা¤প্রতিকসময়ে পার্কটির সংস্কার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ডিসি বাংলো পার্কের প্রধান তোরণ নির্মাণ, পার্কের নিচের অংশে দেওয়াল, বসার স্থান তৈরি, বিভিন্ন খেলনা ও ব্যাঙের ছাতাসহ অন্যান্য সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাঙামাটি শহরের বাসিন্দা ও উন্নয়নকর্মী নুকু চাকমা মনে করেন, ডিসি বাংলো এলাকাটা কাপ্তাই হ্রদ তীরবর্তী পার্ক। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী এলাকা। এটি শুরু থেকে উন্মুক্ত ছিল এবং এটি উন্মুক্তই থাকুক এটাই তার প্রত্যাশা। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে টিকিটের আওতায় আনলে জনসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হবে।

শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর আসর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈকত রঞ্জন চৌধুরী বলেন, ডিসি বাংলো পার্কটি শুধু আজকে নয়, দীর্ঘদিন ধরেই শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের জন্য গুরত্বপূর্ণ একটি জায়গা। টাকার বিনিময়ে সেটিতে প্রবেশ করানোর বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সবাইকে ব্যবসা করতে হবে কেন? এমন একটি উন্মুক্ত স্থান ব্যবসায়িকভাবে আবদ্ধ বা পরিচালিত হওয়া রাঙামাটিবাসীর জন্য দুঃখজনক। পার্কটি নিয়ে যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে জেলা প্রশাসন ভিন্নভাবে সমাধান করতে পারে।  টাকা ছাড়া স্থানীয়দের একটি নিঃশ্বাস নেয়ার স্থান উন্মুক্ত থাকুক। ফি দিয়ে প্রবেশের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুক জেলা প্রশাসন।

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, শিশু-কিশোরদের জন্য এখনকার খেলার মাঠ আর উন্মুক্ত জায়গা নেই বললেই চলে। ডিসি বাংলো পার্ক রাঙামাটির একটি ঐতিহাসিক স্থান; সেখানে শত বছরের প্রাচীন চাপালিশ গাছও রয়েছে। রাঙামাটিতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে মানুষের ক্লান্তি ও অবসাদ দূরীকরণের জন্য উন্মুক্ত স্থান হিসেবে পার্কটি আইকন। আমরা আবেদন জানাব পার্কটিতে বাণিজ্যিকীকরণের ভাবনা থেকে সরে আসা হোক।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার বলেন, শিশু কিশোর ও সাধারণ মানুষের চিত্তবিনোদনের জায়গাগুলো সংকুচিত হয়ে আসছে। যেভাবে বাণিজ্যিকভাবে সবকিছু গড়ে তোলা হচ্ছে সেখানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কিছু নেই একমাত্র ডিসি বাংলো পার্কটি ছাড়া। কিন্তু সা¤প্রতিকসময়ে এটিকে টিকিট ফি দিয়ে প্রবেশের যে আয়োজনের কথা আমরা শুনছি সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। পার্ক সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন, অন্যথায় এর নেতিবাচক প্রভাবে শিশু কিশোরদের বেড়ে ওঠার ওপরও প্রভাব ফেলবে।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানায়, ডিসি বাংলো পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হচ্ছে। টিকিটের মাধ্যমে প্রবেশ মূল্য দিয়ে দর্শনার্থী প্রবেশের বিষয়ে ভাবছে জেলা প্রশাসন। তবে জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে জেলা শহরের একমাত্র উন্মুক্ত পার্কটিতে প্রবেশে টিকেট দিয়ে প্রবেশ করা কিংবা উন্মুক্ত রাখার বিষয়টি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, ‘সন্ধ্যায় পার্কের ভেতর মাদকসেবন ও বিভিন্ন খারাপ কাজ হতো সে জন্য পার্কের পরিবেশটা ঠিক করার জন্য পার্কের সৌন্দর্য্য ও শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা পার্কটাকে সুন্দর করতেছি। তবে এখনো টাকা পয়সা বা টিকেট করবো কিনা সেটা বিষয়ে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিই নাই। একটা চিন্তা ভাবনা করতেছি, তবে এটা ফাইনাল না। টিকেট আমরা নাও করতে পারি।’

তবে বিগত সময়ে পার্কটি ব্যাক্তি পর্যায়ে লিজ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বিকাল বেলা মানুষের হাটাহাটির সুবির্ধাথে সাবেক জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ লিজটির মেয়াদ শেষ হলে লিজটি বাতিল করে দেন এবং জনগনের চলাচলের জন্য পার্কটি উন্মুক্ত করে দেন।