সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। দুঃসময়ে দলের নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ নম্বর রাঙামাটি আসনে চেয়েছেন দলের মনোনয়ন। রাঙামাটির আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘ত্যাগী নেতা’ হিসেবে পরিচিত অমর কুমার দে পাননি দলের মনোনয়ন। অবশেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন অমর কুমার দে। তাঁর নির্বাচনি প্রতীক ছড়ি (লাঠি)।
এদিকে, রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই নির্বাচনি প্রচারে নেমেছেন প্রার্থীরা। গতকাল বুধবার (২০ ডিসেম্বর) সকাল থেকে রাঙামাটি শহর এলাকায় নির্বাচনি প্রচারে নামেন অমর কুমার দে। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে চাইছেন ভোট। তবে একেবারে যেন ভিন্নচিত্রে প্রচারে নেমেছেন তিনি। সঙ্গে নেই কোনো কর্মী-সমর্থক। একাই ভোটারদের লিফলেট বিতরণ করছেন; কথা বলছেন, ভোট চাইছেন। প্রায়ই ভোটারের কাছ থেকে আসছে একই প্রশ্ন আবার নেমে যাবেন না তো? প্রতি উত্তরে অমর বলছেন, ‘নেমে গেলে তো আগেই প্রত্যাহার করে নিতাম’। আবার কেউ কেউ অমরকে জানাচ্ছেন তাঁর সাহসীকতার জন্য ‘স্যালুট’।
সকাল থেকে রাঙামাটি জেলা শহরের বনরূপা, হ্যাপির মোড়, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনি গণসংযোগ করেন অমর কুমার দে। ছড়ি প্রতীকের এই প্রার্থী জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছি। নির্যাতিত হয়েছি, হামলার শিকার হয়েছি। কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। দল আমাকে অবহেলা ছাড়া কিছুই দেয়নি। শেষমেষ দলের মনোনয়ন চেয়েছি, সেখানেও মনোনয়ন পাইনি। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী না হয়ে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের হয়ে প্রার্থী হয়েছি। এটি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি রাজনৈতিক দল। রাঙামাটিতে আমি ছাড়াও অন্য দুইজন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আছেন। আমি মনে করি তিনজনের মধ্যে থেকে ভোটাররা যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রার্থীকে বেচে নিবেন।’
এদিকে, নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে অমর কুমার দে সাতটি দাবি ও প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো দশ উপজেলা ও ১২টি থানা নিয়ে গঠিত রাঙামাটি সংসদীয় আসনের দুর্গম অঞ্চলের ১৮টি ভোটকেন্দ্রে হেলিকপ্টার দিয়ে যেতে হয় বিধায় জেলায় যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম করা জরুরি; রাঙামাটিকে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন নগরী গড়ে তোলা এবং রেল যোগাযোগ স্থাপন করা; রাঙামাটি শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী রাউজান থেকে গ্যাস সঞ্চালন লাইন চালু; পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সকল সম্প্রদায়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করা; পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো অধিকারের কথা লেখা নেই, সুতরাং জেলা পরিষদে দুইজন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান; রাঙামাটিতে বিমানবন্দর স্থাপন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পতি করে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি রক্ষা করা।
জানা গেছে, অমর কুমার দে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপপ্রচার সম্পাদক। এছাড়া রাঙামাটি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। অমর কুমার দে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ রাঙামাটি জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি ও জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে কেন্দ্রীয় হিন্দু ফেডারেশনের সহসভাপতি ও জেলা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তবে আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো পদ নেই তার, যদিও রাঙ্গামাটিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একনামে পরিচিত তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, দুঃসময়ে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন অমর। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা হলেই হামলার লক্ষ্য ছিল অমর কুমার দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে সুসময়ে দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে মূল্যায়নের বদলে বরং অবহেলা পেয়েছেন অমর। ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে প্রভাব হারিয়েছেন তিনি। এর আগে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন অমর কুমার। পরে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। সবশেষ রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ নম্বর রাঙামাটি আসনে ৫ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন এবং প্রার্থিতা বৈধতা পেয়েছেন। তারা হলেন- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদার, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হারুনুর রশিদ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত প্রার্থী অমর কুমার দে এবং তৃণমূল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান।
তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হারুনুর রশিদ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। প্রত্যাহার শেষে সাংবাদিকদের সাবেক সংসদ সদস্য ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেছিলেন, ‘দেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় দলের সিদ্ধান্তে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন’। অন্যদিকে, দল নির্বাচনের মাঠে থাকলেও দলের সিদ্ধান্ত না নিয়ে ‘ব্যক্তিগত’ভাবে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হারুনুর রশিদকে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে ‘বাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন জেলা জাতীয় পার্টি।
তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর দুইজন ভোটযুদ্ধ থেকে সরে যাওয়ায় রাঙামাটি আসনে এখন প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন তিনজন। সরে যাওয়া দুইজনের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত ‘হেভিওয়েট’ প্রাথী ঊষাতন তালুকদার মনোনয়ন প্রত্যাহার করায় রাঙামাটি আসনে ভোটের আমেজ কমে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলা থেকে কেবল রাঙামাটি আসনেই আঞ্চলিক দলের সমর্থনে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন ঊষাতন। তার মনোনয়ন প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় আঞ্চলিক দলের পক্ষ থেকে আর কোনো প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই।
বর্তমানে এই আসনে নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদার, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত প্রার্থী অমর কুমার দে এবং তৃণমূল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান। তিন প্রার্থীর মধ্যে দীপংকর ও অমর কুমারের বেশ পরিচিতি থাকলেও মো. মিজানুর রহমান আলোচনায় আসেন ভোটে দাঁড়িয়ে। দলীয় শক্তি সামর্থ্য, সমর্থন ও ‘শক্তিশালী’ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার জয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন বলে মনে করছেন ভোটাররা।