নিহত চারজনের মধ্যে রুহিনসা ত্রিপুরা ছাড়া বাকী তিনজনই ছিলেন অবিবাহিত এবং বয়সসীমা পঁয়ত্রিশের নিচেই।
এরমধ্যে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-র সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমানে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা-র বাড়ি পানছড়ি হবার কারণে দাহক্রিয়ায় কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। শিশু-নারী থেকে শুরু সববয়সী মানুষের অংশগ্রহণকে এলাকার সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিরা, বিনয়ী মানুষ বিপুল চাকমা-র রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার কারণেই ঘটেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
তাঁর প্রাথমিক ও পানছড়ি মডেল হাইস্কুলের শিক্ষকরা জানান, বিপুল লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলো। তারচেয়েও বেশি তাঁর মধ্যে পাহাড়ি জনগণের প্রতি একটা মমত্ববোধ পরিলক্ষিত হতো।
পানছড়ির চেঙ্গী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের করল্যাছড়ি গ্রামের বুদ্ধধন পাড়ার সুনয়ন চাকমার একমাত্র ছেলে বিপুল চাকমা (৩২)। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে ২০০৬ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ওখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাজনীতিতে জড়ান। সহপাঠী ও সহকর্মীরা জানান, ২০১০ সালে ঢাকার তীতুমীর কলেজে মাস্টার্স করাকালীন সময়ে ঢাকার রাজপথেও বিপুল পরিচিতি অর্জন করেন, বাকপটু বিপুল চাকমা।
কলেজ জীবনে বিপুল চাকমা-র রুমমেট রাঙামাটির উদীয়মান সাংবাদিক হিমেল চাকমা জানান, সামাজিক মাধ্যমে মঙ্গলবার সকালে চারটি দেহের মধ্য মেঝেতে বিপুলের মরদেহ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
তার কারণ বিপুল আমার সাথে ছিল প্রায় ৬ মাস। খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজে পড়াকালীন কলেজের পেছনে বাঙালী পাড়ায় ভাড়া বাসায় এক বিছানায় থাকতাম। আমার রান্না বিপুল খেয়েছে। আমিও বিপুলের রান্না খেয়েছি। বিপুল তখন শুধু একজন ছাত্র ছিল। রাজনীতি করত না। আমি অনার্স পড়তে রাঙামাটি পাড়ি জমালে সে রাজনীতিতে জড়ায়। অল্প সময়ে সে বড় পদ পায়। বিপুলের মৃত্যু আমাকে আহত করেছে চরমভাবে।
২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর বিপুল চাকমা-র মা দূরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যান। ওই সময় বিপুল রাজনৈতিক মামলায় খাগড়াছড়ি কারাগারে বন্ধী ছিলেন। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে পুলিশ প্রহরায় মায়ের দাহক্রিয়া অনুষ্ঠানে তাঁর আবেগঘন এক রাজনৈতিক বক্তব্য এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানেও তাঁকে একনজর দেখতে প্রত্যন্ত করল্যাছড়ি গ্রামে অঢেল মানুষের উপস্থিতি ঘটেছিলো।
সোমবার রাত আনুমানিক ১০টার দিকে রোমহর্ষক এই হত্যাকান্ড ঘটলেও পানছড়ি পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করেন ১৮ ঘন্টার পর মঙ্গলবার শেষ বিকেলে। সেই লাশের গাড়ি খাগড়াছড়ি জেলাসদর হাসপাতালে পৌঁছে পোস্টমর্টেম শেষ হয়ে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় বুধবার দুপুরের পর। তার মানে প্রাণহানির প্রায় চল্লিশ ঘন্টা পরই তাঁদের অন্তিমযাত্রা শেষ হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পোস্টমর্টেম চলাকালে অনেক মানুষ যে যার মতো লাশগুলো দেখার চেষ্টা করছিলো। তাঁদের একজন বিপুলের বন্ধুর ছোট বোন রুপালি চাকমা।
তিনি বলেন, ভয় শঙ্কা উপেক্ষা করেই আমরা হাসপাতালে জাতির জন্য নিবেদিত তরুণদের শেষ দেখা সারতে এসেছি।
নিহত চারজনের মধ্যে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ-সভাপতি লিটন চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের দ্রোনাচার্য কার্বারি পাড়ায়, তার পিতার নাম মৃত. চিন্তা মুনি চাকমা।
লিটনের বড় ভাই সুগতি চাকমা; ভাইয়ের মৃত্যুতে যতো না সন্ত্রস্ত তার চেয়ে বেশি ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
তিনি মনে করেন, এসব বন্ধ না হলে অসহায় পাহাড়িদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে।
লিটনের সহপাঠী হীরা চাকমা জানান, জাতির জন্য ভালো কিছু করার মানসিকতা নিয়ে কলেজ জীবন থেকেই লিটন আন্দোলনমুখী ছিলো। রাজনীতির জন্য ওকে জীবনের বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরবাড়ি এবং পরিবার ছেড়ে থাকতে হয়েছে।
ইউপিডিএফ-র পানছড়ির দুধুকছড়া এলাকার সাংগঠনিক সম্পাদক সুবোধ চাকমা জানান, পাহাড়ি জনগণের জীবনের নিরাপত্তার কথা প্রশাসন ভাবছে না বলেই এমন হত্যাকান্ডগুলো ঘটছে। এখানে প্রশাসনের দায় এড়িয়ে যাবার কোনই সুযোগ নেই।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সুনীল ত্রিপুরার বাড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলার বড়নাল ইউনিয়নের সুরেন্দ্র রোয়াজা হেডম্যান পাড়ায়। তার পিতার নাম সুখেন্দু বিকাশ ত্রিপুরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে স্নাতকোত্তর এই তরুণ রাজনীতিতে ফুলটাইমার ছিলেন। রাজনীতির কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাবাধীন এলাকায় থেকেও অকালে জীবন হারিয়েছেন।
নিহত সুনীলের ছোট ভাই গণেশ্বর ত্রিপুরা জানান, পাড়া এবং পরিবারের মধ্যে সুনীলই একমাত্র উচ্চশিক্ষিত ছিলো। তার ।মৃত্যুতে আমরা দিশেহারা। ঘটনার ৪০ ঘন্টারপর বুধবার বেলা তিনটার দিকে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এতেই বুঝেছি আমরা কতোটা অসহায়!
সোমবারের ঘটনায় অপেক্ষাকৃত বয়োজেষ্ঠ্য ছিলেন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে রাজনীতিক হয়ে উঠা নিহত রুহিনসা ত্রিপুরা রুহিন। মূলত: ইউপিডিএফ নেতাকর্মীদের সাথে চলতে চলতেই তিনি পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
পানছড়ির উপল্টাছড়ি ইনিয়নের পদ্মিনী পাড়ার বাসিন্দা জনাধন ত্রিপুরার ছেলে রুহিনসা ওইদিন তরুণ নেতাদের সাথে থাকার কথা ছিলো না।
পরেরদিন মঙ্গলবার পূর্ব নির্ধারিত যুব সম্মেলন’র কারণেই নিজবাড়ি ছেড়ে অনাহুত মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছেন।
রুহিনের বড় ভাই চন্দ্র জয় ত্রিপুরা বুধবার ভাইয়ের লাশ গ্রহণ করতে খাগড়াছড়ি জেলাসদর হাসপাতালে এসেছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এমন মৃত্যু যেনো সরকার বন্ধ করে।
বিপুল চাকমা’র কাকীমা গৌরি চাকমা জানান, বংশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানটি রাজনীতির বলী হলো। তিনি দৃঢ়তার সাথে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির দাবি ব্যক্ত করেন।
এদিকে এই ঘটনায় নিহত বিপুল চাকমার কাকা নিরুপম চাকমা বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয়ের ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করে বুধবার শেষ বিকেলে পানছড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন পানছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আজম।
মামলার বাদী নিরুপম চাকমা বলেন, ‘ঘটনার সময় যেহেতু আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না তাই অপরাধীদের দেখিনি। সে জন্য অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেছি। আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা এখন পুলিশের কাজ।
পানছড়ি থানার ওসি শফিউল আজম বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। লাশ জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পানছড়িতে এই ঘটনার পর থেকে ইউপিডিএফ ঘরানার বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন সবাই। তবে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর আরো দায়িত্বশীল ভূমিকার দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গত সোমবার (১২ ডিসেম্বর) রাত ১০টার দিকে পানছড়ি লোগাং ইউনিয়নের অনিলপাড়ায় ইউপিডিএফের চারজন নেতা-কর্মী নিহত হয়। নিহতরা হলেন ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা (৩২), গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের জেলা সহসভাপতি লিটন চাকমা (২৯), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা (২৯) ও ইউপিডিএফের সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা (৪৯)। এই ঘটনায় পিসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য নীতি দত্ত চাকমা, হরিকমল ত্রিপুরা, প্রকাশ ত্রিপুরা নামের তিনজন নিখোঁজ আছেন বলে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
এই হত্যাকান্ডের জন্য প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ’র পক্ষ থেকে শ্যামল চাকমা’র নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে দায়ী করা হলেও হত্যার দায়-দায়িত্ব এখনো কেউ স্বীকার করেনি।