প্রকাশঃ ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০৩:১২:৪৪
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০৬:৩০:৪৪
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ১৯৯৭ সালের আজকের এদিনে (২ ডিসেম্বর) পাহাড়ে ‘শান্তি ফেরাতে’ বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনতে জনসংহতি সমিতি পাহাড়িদের পক্ষে চুক্তি সই করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার নিরসন, জনসংহতি সমিতির গেরিলা সংগঠন শান্তি বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পণ এবং পাহাড়িদের অধিকারের প্রশ্নে বিভিন্ন দাবি নিয়ে ৭২টি ধারায় চুক্তি সাক্ষর হয়েছিল। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, চুক্তি সই পাহাড়ের অস্থিতিশীল পরিবেশকে শান্ত হবে। ঐক্যের বন্ধনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমান্তরাল এগিয়ে যাবে পাহাড়ের মানুষ।
সেই ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সইয়ের ২৬ বছরেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। থামেনি খুনোখুনি, সংঘাত। ঐক্যের বদলে বেড়েছে বিভেদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন চিত্র পাল্টেছে ঠিকই। দুর্গম এলাকায় এখন আলো পৌঁছেছে, হয়েছে সড়ক। আবার এখনও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নেই মৌলিক অধিকারের অনিশ্চিয়তা। চুক্তি সই পরবর্তী এই ২৬ বছরেই পাহাড়ের একমাত্র রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে গড়ে উঠেছে আরও তিনটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। গড়ে উঠেছে জাতিগত বা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক দলও। যে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি হয়েছিল সে পাহাড়ে এখন ঐক্যের বদলে হয়েছে বিভেদ। চুক্তি করেও পাহাড়ে শান্তি না ফিরলেও প্রকৃত শান্তি কোন পথে?- এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের।
একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আন্দোলন করতে গিয়ে জনসংহতি সমিতির নেতারা ‘হয়রান’ হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন। অন্যদিকে চুক্তি সাক্ষরকারী সরকার পক্ষের নেতারা বলছেন, বাস্তবতা না বুঝলে, ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ না হলে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২৬ বছরের আন্দোলনের পরও আরও বহু বছর অতিক্রম করলেও বাস্তবায়িত হবে না। জনসংহতি সমিতির হিসাবে, চুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হলেও অবশিষ্ট ২৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। সরকার পক্ষ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দাবি, ‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা’ ব্যতিত বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে চুক্তির বেশকিছু ধারাকে ‘বিতর্কিত’ দাবি করে সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে বাঙালিভিত্তিক সংগঠনসমূহ।
ইতিহাস বলছে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) চুক্তি সইয়ের এক বছর পর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ইউনাইটেড পিপলস ডোমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার শুর থেকেই সংগঠনটি চুক্তি বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ইউপিডিএফ পার্বত্য চুক্তিকে ‘কালো চুক্তি’ মনে করে। প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠার পর পাহাড়ে শুরু হয় জেএসএস-ইউপিডিএফের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে অন্তঃকোন্দল দেখা দেয় জনসংহতি সমিতির মধ্যেই।
২০১০ সালের দিকে জনসংহতি সমিতি থেকে বেড়িয়ে এসে তাতিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে), সুধাসিন্ধু চাকমার নেতৃত্বে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। এরপর ২০১৫ সালের দিকে চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফের মধ্যেও অন্তঃকোন্দল দেখা দেয়। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে তপন জ্যোতি চাকমাসহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি আঞ্চলিক সংগঠন। এই তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাই ছিলেন একসময়ে ইউপিডিএফের সশস্ত্র শাখার (সামরিক শাখা) প্রধান। পাহাড়ে এখন জেএসএস ভেঙে গড়ে উঠেছে চারটি আঞ্চলিক দল।
জনসংহতি বিরোধী কেএনএফের সঙ্গে ‘শান্তি সংলাপ’:পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) নামে সশস্ত্র সংগঠনের পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামের আরেকটি সশস্ত্র সংগঠন আলোচিত হয়েছে। গত বছরের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজমপাড়ায় তিন পাড়াবাসীকে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে ‘বম পার্টি’খ্যাত কেএনএফ। সংগঠনটি নিজেদের সশস্ত্র শাখার নাম দিয়েছে কুকিচিন ন্যাশশাল আর্মি-কেএনএ।
সংগঠনটির তৎপরতা বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়েই সীমাবদ্ধ ছিল। পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল কেএনএফ। এছাড়া সাধারণ মানুষ ও সেনাসদস্য হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িয়েছে কেএনএফ। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির ঘোর বিরোধীতা করে আসছিল। পাহাড়ে বর্তমানে চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল থাকলেও বরাবরই জেএসএসের বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ কেএনএফ। কেএনএফের দাবি, পাহাড়ে অস্থিতিশীলতা ও জাতিগত বৈষম্যের পেছনে সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি’ই দায়ী।
গত ৫ নভেম্বর বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুনলাই পাড়ায় কেএনএফের সঙ্গে প্রথম সরাসরি বৈঠক করেছে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’। ‘শান্তি সংলাপ’ শেষে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেছিলেন, “ডিসেম্বরে আবার একটি সরাসরি বৈঠকের বিষয়ে দু’পক্ষ একমত হয়েছে। সেই সময় পর্যন্ত কেউ সংঘর্ষে জড়াবে না এবং উভয়পক্ষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করবেন।” এই ‘শান্তি সংলাপের’ পরই বাস্তুচ্যুত কিছু পরিবার ভারতের মিজোরাম থেকে বান্দরবানের রুমায় ফিরেছেন। পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভাবছেন, জেএসএস বিরোধী কেএনএফকে ‘শান্ত করতে’ নতুন কোন চুক্তি প্রয়োজন পড়ে কি-না?
এখনও ‘দোষারোপের বৃত্তে’:
সরকারের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরকারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার আপেক্ষ করলেন; বিগত ২৬ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানাতে জানাতে তারা ‘হয়রান’ হয়ে গেছেন। ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবির কথা বলতে বলতে আমরা হয়রান হয়ে গেছি। আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে খুবই আন্তরিক। আমরা আশাবাদি তিনি খুব শীঘ্রই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।’
এদিকে, গত মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) ২৯৯ নম্বর রাঙামাটি আসনে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ফরম দাখিল শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঊষাতন বলেছেন, ‘তিনি পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে কাজ করতে চান।’
চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি দীপংকার তালুকদার এমপি বলেন, ‘প্রত্যেকটা নদীর লক্ষ্য থাকে সমুদ্রে মিশে যাওয়া। কিন্তু সব নদী সমুদ্রে মিশে যেতে পারে না; মাঝখানে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে, শুকিয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি সমাধানের জন্য বিএনপি সরকার চেষ্টা করেছে, পারেনি। এরশাদ সাহেব চেষ্টা করে একটা স্ট্রাকচার করেছে কিন্তু সমাধানের পরিপূর্ণ রূপরেখা করতে পারেননি। আমরা (আওয়ামী লীগ) করতে পেরেছি নেত্রীর বিচক্ষনতা, সাহসীকতা, রাজনৈতিক বিজ্ঞতার কারণে। শান্তিকামি মানুষের মতো আমাদের আশা ছিল শান্তি চুক্তি বাস্তবায়িত হবে, এখনো হয়নি। আমরা চুক্তির ২৬ বছর পূর্তি আমরা পালন করছি। যে কোনো শান্তিকামি মানুষের মতো চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কষ্টে আমাদের মন কাঁদে, কষ্ট হয়।’ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার প্রসঙ্গ টেনে দীপংকর বলেন, ‘প্রতিবন্ধকতা দূর করা না গেলে চুক্তি বাস্তবায়নের স্বাচ্ছন্দ গতি পাবে না। যারা শান্তি চুক্তিকে ‘কালো চুক্তি’, ‘সংবিধান বিরোধী’, ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বলেছিল তাদের সঙ্গে জনসংহতি সমিতি আঁতাত করে ২০০১ সালের নির্বাচনে। এটি অন্যতম প্রধান প্রতিকূলতা।’
যারা ‘শান্তি চুক্তি’ মানে না (বিএনপি) তারা কিভাবে বাস্তবায়ন করবে- এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দীপংকর বলেন, ‘যারা (জেএসএস) শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দাবি করছে তারা যদি মনে করে আওয়ামী লীগকে উচ্ছেদ করে নিশ্চিহ্ন করে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে সেটিও একটি ভুল। এই ভুল করতে গিয়েই আমাদের আওয়ামী লীগ নেতাদের গুলি করে হত্যা করে। রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ববোধ- এগুলা হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। বাস্তব অবস্থা বুঝতে না পারলে, দেওয়া-নেওয়ার সমঝোতা যদি না হয়; সিদ্ধান্ত-বিবেচনা করতে যদি না পারি ২৬ বছরের পরও আরও অনেক বছর অতিক্রম হলেও শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন জেলা যাবে না মন্তব্য করেন দীপংকর তালুকদার।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ‘কালো চুক্তি’ মন্তব্য করেছিল তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্ব। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী হয়েছিলেন রাঙামাটি আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মনি স্বপন দেওয়ান। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী মনি স্বপন দেওয়ান বলেছেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও শান্তি চুক্তি বাতিল করেনি। এই চুক্তিকে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক আছে নির্বাচনে ভোট প্রদান ও ভূমি সংক্রান্ত ব্যাপারে। এগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতো। আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছিল। এখন গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও সংসদে তো এই চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি মনে করি চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের গাফিলতি আছে। কিছু বিতর্কিত বিষয় আছে; এগুলো সমাধানের পথে না গিয়ে ইচ্ছে করেই জিইয়ে রেখেছে।’
মনি স্বপন দেওয়ান বলেন, ‘অর্থনৈতিক অস্থিরতা থাকলে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে আসবে; রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে সেখানে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলে আসবে। আর দুইটি সমস্যাই যদি থাকে সেখানে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দেবে। আওয়ামী লীগ এত সময় পেলেও নিরাপত্তাজনিত এই সমস্যা সমাধান করলে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা যে ভবিষ্যতে দেখা দেবে না এটির গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন না। সরকারের দায়িত্ব এই বিষয়টির সমাধান করা।’