হারিয়ে গেলে খুঁজি কারে : প্রান্ত রনি

প্রকাশঃ ০৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০৭:১০:৫৮ | আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০২:১৩:৩১

আমাদের মতো মানুষের একটা বড় ব্যাপার হলো আমরা থাকতে মর্ম বুঝি না, খুঁজি না। কিন্তু যখন হারাইয়া যায়, চলে যায়, মরে যায়; তখন খুঁজি, চাই আর হাহাকার করি। মানুষটা ভালো ছিল, পাখিটা মরে গেলো, নদীটা ভরাট হয়ে গেলো, এমনই সব হাহাকার আর বিষন্নতা, বিষাদে ভরাই মন।

 

নিজের কথাই বলি। আমার এক বন্ধু; বলা যায় বাল্য বন্ধুই। প্রায়ই সময় আমাকে ফেসবুকে নক দিতো।যোগাযোগ করতো, খোঁজখবর নিতো-দিতো। আমিও রেপ্লে দিতাম, মাঝে মধ্যে ব্যস্ত থাকার কারণে বললাম পরে কথা বলবোরে। এখন কিঞ্চিৎ ঝামেলায় আছি। ওই বন্ধু এখন দেশে নেই, প্রবাসে। দেখা নাই বহু বছর। না হলেও সাত বছর। অথচ আমাদের কত স্মৃতি ছিল, আছে। এখন আর আমারে নক দেয় না, যোগাযোগ করে না; হয়তো আমারই অবহেলায়। এখন আমিও হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর জন্য হাহাকার করছি। এমন ঘটনা বহুজনের, বহু রকমের। আমরা আসলে এমনই। কেউ বাদে কেউ না, প্রায় সবাই। হারানো জিনিস, হারানো বই, হারানোর মানুষের জন্য কাঁদি। থাকতে দেখি না, পড়ি না, মূল্যায়ন করি না। 

 

এখনকার দিনে এইসব বাড়তেছে আমাদের ব্যক্তিত্ব বাড়ার কারণে। আমরা ব্যক্তিত্বের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। শৈশব, কৈশোরের ফেলে আসা আনন্দকে যৌবনে বিষাদ করে ফেলছি। এইসব ব্যক্তিত্ব হয়তো আমাদের বার্ধক্যে ভোগাবে, আরও একা করবে। আমরা এখন আর প্রাণখুলে আড্ডা দিতে পারি না, হিহি-হাহা করে হাসতে ভুলি যাচ্ছি। মানুষ কী ভাববে কে কিভাবে দেখছে আমাকে সস্তা সিম্পল মনে করবে নাতো এইসব ভাবতে ভাবতে আমরা দিনদিন একা হয়ে যাচ্ছে। লাভের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছি। 

 

কথা সত্য; আজ-কালকার দিনে কিছু মানুষের খোঁজখবর নিলে সবাই সমানভাবে দেখে না। কেউ ভাবে এই বুঝি আমার থেকে কিছু চেয়ে বসে। কোনো কারণ তো হয়তো আছে; এড়িয়ে চলি সেই ভালো। আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদেরও মাঝেও এই আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে। কিন্তু দিনশেষে মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রক্ষা যোগাযোগ বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে-অন্যের মানসিক-শারীরিক খোঁজখবর নেয়া জরুরি, অন্তত এখনকার দিনেই বাস্তবতার জন্য হলেও

 

অবশ্য একটা প্রবাদও আছে "মানুষ পাল্টে যায়" এই প্রবাদটা আমি সব সময়ই উড়িয়ে দিয়েছি, এখনও তাই দিচ্ছি। মানুষ আদতে পাল্টায় না। মানুষ হিসেবে আমাদের যার চরিত্র, মানসিকতা যেমন তেমনই থাকে; কেবল সুসময় আরদুঃসময়কালটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার ভেতরের যে তেঁতো মানসিকতা সেটি আমি ঠিকই ব্যবহার করবো যখন সময়-সুযোগে মিলবে, এর আগে চুপিসারে বেঁচে থাকা। প্রকৃত চেহারায় ঢাকনা দিয়ে উদ্ভূত প্রভু সাজা। কিন্তু যখন সুসময় আসে আমরা নিজের প্রকৃত মুখমণ্ডল প্রদর্শন করি। তাই আমি বলি মানুষ পাল্টান না, সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। এই ধরণের মানুষের হন পরহিংসাকারী, জিঘাংসায় ভরে মানুষ। তারা নিজের কোনো ক্ষতি সাধনের কারণ না থাকলেও অন্যের সফলতা, খুশি-সুখ মেনে নিতে পারেন না। ঈর্ষায় ভূগেন

 

একটু যদি ভেবে দেখি। বিগত কয়েকবছর ধরে মানুষের মধ্যে, বিশেষত উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়েছে। বেশির ভাগই কারণ দেখা গিয়েছে অভিমানে। কখনো পারিবারিক জটিলতা-কলহের জেরে অভিমান, কিংবা কখনো প্রেমঘটিত কারণ। মানুষের মধ্যে অভিমানের পাহাড় জমে যাচ্ছে। মানসিকভাবে এখন বেশিরভাগ মানুষই বিপর্যস্ত। হয়তো কেউ প্রকাশ্যে বলেন, অন্যকে শেয়ার করেন। আবার কেউ মুখফুটে বলতে পারেন না, শেয়ার করতে পারেন না। নিজের ভেতরে চেপে রাখা অভিমান এক সময় বারুদ হয় মানুষটাকে মুহূর্তের মধ্যে নাই করে ফেলে। এভাবে আমাদের কত মানুষের কত স্বজন, সন্তানরা অকালে চলে গেছেন পৃথিবী থেকে। একটা জ্বলন্ত জীবন নিভে যায় অগোচরে-নিভৃতে

 

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মান-অভিমানের বশে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে; এর হার ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তাদের বড় অংশেরই অভিমান ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। অন্য কারণের মধ্যে প্রেমঘটিত অন্যতম; এর হার ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। এছাড়া পারিবারিক কলহে দশমিক ১৪ শতাংশ, হতাশায় দশমিক শূন্য , মানসিক সমস্যায় দশমিক ৭৯, আর্থিক সমস্যায় দশমিক ৭৯ এবং উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিয়েছে দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী

 

আগেকার সময়ে তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতো। দুপুর শেষ বিকেল ঘনিয়ে এলে তারা খেলার মাঠে ছুটে চলতো। কেউ ফুটবল, কেউবা ক্রিকেট কিংবা কেউ ঘুড়ি উড়ানোসহ বিভিন্ন খেলাধূলা বিনোদনের ব্যস্ত থাকতো। গান আড্ডায় ব্যস্ত থাকতো। এখন শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও খেলাধূলার আয়োজন কমে গেছে। পড়াশোনার বাড়তি চাপ, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটকেন্দ্রিক ব্যস্ত হয়ে পড়া মানুষ ক্রমশঃ একা আর বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে নিজেদের অজান্তেই। দলবদ্ধতা থেকে একা হয়ে পড়া মানুষ আর চাইলেই দলবদ্ধ হয়ে উঠতে পারে না। যে সময় তাদের খেলাধূলা, বিনোদনের ব্যস্ত থাকার কথা সেই সময়টাতে অনেকেই হয়ে যাচ্ছে প্রেমঘটিত কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত। এই সবের প্রভাব ফেলছে আমাদের জীবনে

 

শহুরাঞ্চলে বড় বড় ইমারত আর অবকাঠামো তৈরির প্রতিযোগিতায় প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে খেলার মাঠ। শহর এলাকায় এখন খেলার মাঠ খুঁজে পাওয়া যায় খুবই কম। খেলার মাঠে, পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় আবাসন। এই সব ব্যবস্থায় হুমকির মুখে ফেলেছে তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতকে। গ্রামের ক্ষেত্রেও পড়েছে শহরের প্রভাব। গ্রামের কিছু মানুষ আছেন যারা নিজেদের বসবাস করা সমাজের মধ্যে এগিয়ে থাকেন; তাদের একটা বড় অংশ এখন আর গ্রামে থাকেন না, থাকতে চান না। শহরমুখে হয়ে পড়েন। গ্রামের নিরাপদ, মুক্ত আলো বাতাস ছেড়ে আসেন শহরের দূষিত বাতাসের স্বাদ নিতে। এই ধরণের এগিয়ে থাকা মানুষেরাও সঠিকভাবে সচেতন না। এছাড়া গ্রামাঞ্চলেও এখন খেলাধূলার প্রবনতা আগের থেকে অনেকটা কমে গেছে। গ্রামের মানুষের শহরমুখী হওয়া, মোবাইল ফোন আসক্তি বাড়ায় খেলাধূলার আগ্রহ কমে গেছে। আগে গ্রামাঞ্চলে গেলে দেখা যেতো বাচ্চারা বিকেলে আকাশে ঘুড়ি ঘুরাচ্ছে। অথচ ঘুডি উড়ানো দেখিনা বহু বছর

 

মানুষের শারীরিক সুস্থতার মতো মানসিক সুস্থতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ মানসিক বিষয় এগোচরেই থাকে। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বেশির ভাগ মানুষই তার পাশের কাছের মানুষের মানসিকতা নিয়ে, তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে কখনো ভাবেন না। উল্টো মানসিকভাবে বিপর্যয় মানুষটাকে হাসি-ঠাট্টার পাত্র ফেলেন অনেকেই। এসব ঘটনা ওই মানুষটাকে আরও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে। একজন মানসিক অসুস্থ মানুষ ক্রমাগত শারীরিক অসুস্থও হয়ে পড়েন। আমাদের চারদিকের মানুষজন, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, সন্তানদের মানসিকতা সুস্থতার দিকে নজর দেয়া জরুরি। অন্যথায় অকালে আমরা হারিয়ে ফেলবো অজান্তেই কোনো আপন জনকে। হারিয়ে গেলে, হারিয়ে যাওয়া মানুষ আর ফিরে পাওয়া যায় না তখন সহস্র প্রচেষ্টা করেও। তাই নিজের আশপাশের মানুষের যত্ন নিন


 

লেখক: সাংবাদিক