প্রকাশঃ ১৩ জুনe, ২০২৩ ০৮:২৩:৪১
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০৬:৩০:২৬
বিশেষ প্রতিবেদক, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ২০১৭ সালের ১৩ জুন প্রবল বর্ষনে পাহাড় ধসে ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছিল। কাল মঙ্গলবার রাঙামাটিতে সেই ভয়াল পাহাড় ধসের ঘটনার ছয় বছর পূর্ন হবে। ভয়াবহ সেই পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা লোকজনদের পূর্নবাসনের দুরের কথা বরং পাহাড়ের ভাজে ভাজে আরো নতুন নতুন ঘর বাড়ী নির্মাণ করে মৃত্যুকূপে বসবাস করছেন হাজারো লোকজন। আবারো ভারী বৃষ্টিপাত হলে এসব স্থানে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে।
শিমুলতলী, রুপনগর, নতুন পাড়াসহ কয়েকটি স্থানে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ছয় বছর আগে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় রুপ নগর এলাকায় স্বামী-স্ত্রী সালাহ উদ্দীন ও রহিমা বেগম এবং দরবেশ আলী মারা যান। তবে সালাহ উদ্দীন ও রহিমা বেগমের বেঁচে যায় শিশু সন্তান সুমাইয়া ও মিম। ওই সময়ে স্বামী-স্ত্রীর দেহাবশেষও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই মাটি ধসে যাওয়া স্থানে নতুন করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা না হলেও প্রায় দুই থেকে তিনশ গজের দুরে পাদদেশে নতুন করে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। একই স্থানে পাহাড়ের ভাজে ভাজে ঘর রয়েছে। এছাড়া রুপ নগর পাহাড়ের শেষ মাথার দিকে ২০১৭ সালের পর আরো নতুন করে ৫ থেকে ৬টি নতুন করে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নিত্য নতুন করে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব পাদদেশে বসবাসকারীরা পাহাড় ধসের ঝুকিতে রয়েছেন। নতুন পাড়া, শিমুলতলী, লোকনাথ মন্দির এলাকা ভেদভেদীর যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে সেই একই চিত্র দেখা গেছে। মৃত্যুকূপে পুনরায় ঘরবাড়ি নির্মান করে বসবাস করছেন। তবে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুকিপুর্ন এলাকা বসবাস ও স্থাপনা নির্মাণ না করতে নিষেধ করে সাইন টাঙিয়ে দিয়ে সর্তক করা হলেও সেই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না লোকজন।
সেখানে কথা হয় আহমেদ নবী সাথে। তিনি জানান, ২০১৭ সালের সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের কথা ভুলে যাননি। সে কথা মনে পড়লে এখনো আতকে উঠি। এ স্থানে প্রায় দুশ পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই তাই ঝুকিপুর্ণ হলেও বসবাস করতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, পাহাড় ধসের ঘটনায় নিহত সালাহ উদ্দীন ও রহিমা বেগমের বেঁচে যাওয়া শিশু সন্তান সুমাইয়া ও মিমকে থাকার জন্য তাদের চাচা কাউসারকে একটি জায়গা রুপনগর এলাকায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের চাচা জায়গাটি বিক্রি করে দিয়ে মিম ও সুমাইয়াকে নিয়ে এখন কোথায় আসেন জানেন না।
একই এলাকাবাসী জাহাঙ্গীর আলম জানান, এখানে যারা বসবাস করেন তারা সবাই নিম্ন আয়ের লোকজন, তাদের ঘর ভাড়া করে থাকার সক্ষমতা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ঝৃকিপুর্ন হলেও থাকতে হচ্ছে। তবে সরকার তাদেরকে যদি স্থায়ীভাবে পুর্ণবাসন করেন তারা এলাকা ছেড়ে দেবেন। সামুলা বেগম জানান, বৃষ্টি হলে তার ভয় লাগে। কিন্তু যাওয়ার মতো তাদের কোন জায়গা নেই। অতি বৃষ্টিপাত হলে জেলা প্রশাসন থেকে নিকটবর্তী নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য বললে চলে যায়। সরকার যদি তাদের থাকার জন্য সমতল জায়গা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে এই ঝুকিপূর্ন স্থানে বসবাস করবেন না।
অপর গৃহবধু শাহানা বেগম বলেন, ২০১৭ সালে পাহাড় ধসের সময় তারা শহরের রিজার্ভ বাজারে ভাড়া বাসায় ছিলেন। তবে পাহাড় ধসের কয়েক বছর পর এই এলাকা থেকে একটি জায়গা ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তার পাশে আরো নতুন করে ৫থেকে ৬টি নতুন ঘর তৈরী নির্মাণ করে বসবাস করছেন। হাসনাআরা বেগম বলেন, ২০১৭ সালের পাহাড় ধরে পর আর হয়নি। তবে ভারী বৃষ্টিপাত হলে জেলা প্রশাসনের লোকজন গিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায়। ওই এলাকার সিএনজি অটোরিক্সা চালক মোঃ সোহেল রানা জানান, এ এলাকায় উন্নয়ন বলতে কিছুই হয়নি। চেয়ারম্যান এমপি থেকে প্রশাসন এ এলাকাটি কোন সুনজরে দেননি। এলাকার মানুষকে ভাসন্যা মনে করে থাকে। শুধু নির্বাচন আসলে নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন। এই এলাকায় ১৩ থেকে ১৪ বছর ধরে বসবাস করছি কিন্তু কোন উন্নয়ন হয়নি। নতুন পাড়ার বাসিন্দা মোঃ নাসির ও মোঃ রবিউল জানান, পাহাড়ী এলাকায় বৃষ্টির সময় কম বেশী পাহাড় ভাঙ্গে। তবে এখনো ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়নি। ভারী বৃষ্টিপাত হলে কি হবে জানি না। ভারী বৃষ্টিপাত হলে জেলা প্রশাসন থেকে মাইকিং করলে আমরা নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যায়।
একাধিক সত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি রাঙামাটি পৌর সভার ৯টি ওয়ার্ডের ২৯টি স্থানকে ঝুকিপুর্ণ এলাকা হিসেবে চিহিৃত করেছে। এসব ঝুকিপুর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে রিজার্ভ বাজার এলাকার মধ্যে রয়েছে চম্পানির মার টিলা, চেংগিমুখ, আব্দুল আলী একাডেমী সংলগ্ন ঢাল, এসপি অফিস সংলগ্ন ঢাল, মাতৃমঙ্গল এলাকা ঢাল, পুলিশ লাইন সংলগ্ন ঢাল। তবলছড়ি এলাকার মধ্যে এডিসি হিল সংলগ্ন রাস্তার ঢাল, দুর্নীতি দমন কমিশন অফিস সংলগ্ন ঢাল, ওয়াপদা কলোনীর ঢাল, স্বর্ন টিলা, বিএডিসি পাহাড়ের ঢাল। বনরুপা এলাকার মধ্যে দেওয়ান পাড়া পাহাড়ের ঢাল, কাঠালতলী মসজিদ কলোনী পাহাড়ের ঢাল, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সংলগ্ন পাহাড়ের ঢাল, আলম ডক পাহাড়ের ঢাল, গর্জনতলী মুখ, চম্পক নগর এলাকার পাহাড়ের ঢাল, পাবলিক হেলথ এলাকা পাহাড়ের ঢাল। ভেদভেদী এলাকার মধ্যে রয়েছে মুসলিম পাড়া পাহাড়ের ঢাল, রাজমনি পাড়া পাহাড়ের ঢাল, পোষ্ট অফিস কলোনী এলাকা, নতুন পাড়া, শিমুলতলী, রুপনগর, বিদ্যানগর, লোকনাথ মন্দির এলাকা,কিনারাম পাড়া, সিলেটি পাড়া, আলুটিলা ও আনসার ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ের ঢাল। কাপ্তাই উপজেলার ঢাকাইয়া কলোনী, কাপ্তাই কার্গো পার্ক, লক গেইট, ব্যাঙ ছড়ি, শীল ছড়িসহ ৯টি ঝুকিপূর্ন এলাকা রয়েছে। এছাড়া নানিয়ারচর, কাউখালী উপজেলাসহ কয়েকটি উপজেলায় পাহাড় ধসের ঝুকিপুর্ন অবস্থায় বসবাস রয়েছে। এসব এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ১৫ হাজারের বেশী পরিবার ঝুকিপুর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঝুকিপূর্ন এলাকা ও আশ্রয় কেন্দ্র চিহিৃত করা হয়েছে ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখার পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। তবে ঝুকিপূর্ন এলাকা থেকে মানুষজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে বেক পেতে হয়। মানুষ সচেতন নয়। ২০১৭ সালে পাহাড় ধসের পর পুর্ণবাসনহ যে সুপারিশ করা হয়েছিল সে বিষয়ে জানতে তিনি বলেন,জায়গা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্ণবাসন করা সম্ভব না।
উল্লেখ্য, টানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড় ধসে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদীর যুব উন্নয়ন বোর্ড এলাকা,মুসলিম পাড়া.শিমুলতলী, রুপ নগর,সাপছড়ি,মগবান,বালুখালী এলাকায় এবং জুরাছড়ি,কাপ্তাই,কাউখালী ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জনের মৃত্যূ হয়। এছাড়া ২০১৮ সালে নানিয়ারচর উপজেলায় পাহাড় ধসে দুই শিশুসহ ১১ জন এবং ২০১৯ সালের কাপ্তাইয়ে তিন জনের প্রাণ প্রাণহানি ঘটে।