প্রকাশঃ ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১২:০৩:৫৭
| আপডেটঃ ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ০৫:১৭:৩০
শাহ আলম, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে নানা আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। তার ব্যতিক্রম নয় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা। পার্বত্য অঞ্চলের “মাদার ডিষ্ট্রিক” খ্যাত রাঙামাটিতে বইছে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া। ২৯৯নং আসনে এবং রাজনীতির ময়দানে পাহাড়ী-বাঙালী সকলের অতি পরিচিত নাম সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার। যাকে সবাই ‘‘দাদা’’ বলে সম্বোধন করে থাকেন।
দেশের অন্যতম বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকেও নির্বাচনের সমতলে মনোনয়ন নিতে ব্যস্ত অনেক প্রার্থী। কিন্তু পার্বত্য জেলা রাঙামাটির ২৯৯নং আসনের প্রার্থীতায় রয়েছে ভিন্নতা।
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহান জাতীয় সংসদের ২৯৯নং আসনে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের একক ‘‘নৌকার মাঝি’’ হতে যাচ্ছেন রাজনীতির তৃণমূল থেকে উঠে আসা উক্ত আসনের তিন বারের নির্বাচিত এমপি দীপংকর তালুকদার।
যদিও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ থেকে এখনো উক্ত আসনে কে হবেন ‘‘নৌকার মাঝি’’ তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সর্বশেষ ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে দীপংকর তালুকদারের কোন প্রতিদ্বন্দী কোন প্রার্থীকে লড়াই করতে দেখা যায়নি। অতীত ইতিহাসের সূত্র অনুযায়ী এবারের আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের একক ‘‘নৌকার টিকেট’’ পাবেন। এই ধারণা স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের।
কে এই ‘‘দাদা’’ ??
দাদার জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিম্নে তুলে ধরা হলো: দীপংকর তালুকদার ১৯৫২ সালের ১২ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মাান) ডিগ্রি অর্জন করেন। দীপংকর তালুকদার ছাত্র জীবন থেকে ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর্দশকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ করে যাচ্ছেন।
উনসত্তর ও সাতাশির গণঅভূত্থানে অংশগ্রহণ করে তিনি দুইবার কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ছাত্র জীবনে তিনি ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র সংসদের সদস্য এবং ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩-৭৪ সালে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এবং ইংরেজি বিভাগীয় সমিতির প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালে তিনি রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে তিনি পরপর দুইবার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এখনো পর্যন্ত তিনি দলটির নেতাকর্মীদের সমর্থনে সভাপতি পদে বহাল রয়েছেন। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে রাঙামাটির ২৯৯ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯৯১ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা কমিটি, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় সংসদ হাউস কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৮ সালে প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদনে রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান।
২০০৯ সালের তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলগের সভাপতি পদে রয়েছেন।
এছাড়া দীপংকর তালুকদার রাষ্ট্রীয় কাজে বিভিন্ন দেশ সফর করেন. এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র,চীন, জাপান, জার্মানী, ফ্রান্স, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্যাংকক এবং ইরানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর করেন।
(দাদা নামে খ্যাত তার উক্ত জীবনীটি তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও পরিবারের ঘনিষ্ঠ আতœীয়-স্বজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা)
নির্বাচনকে সামনে রেখে দাদা’র দৌড়ঝাঁপ:
এবারের নির্বাচন রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের জন্য বাঁচা মরার লড়াই। দীর্ঘ বছর দল ক্ষমতায় থাকলেও রাঙামাটি আসনটি গতবার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে আছে। তারপরও ব্যক্তি ইমেজ দীপংকর তালুকদার এখনো রাজনৈতিক মাঠ সরগরম করে রেখেছেন।
গত নির্বাচনে এমপি পদ হারালেও আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করায় কিছুটা প্রাণ ফিরে এসেছে রাঙামাটির নেতাকর্মীদের মাঝে। তারই সূত্র ধরে দীপংকর তালুকদার পাহাড়ের আনাচে-কানাচে চষে বেড়াচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার ২৯৯নং আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে এখন থেকেই দীপংকর তালুকদার গণসংযোগ শুরু করেছেন।
অন্যদিকে রাঙামাটিতে জাতীয় বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি বরাবরই দুই ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তির মাধ্যমে দলীয় কোন্দল দিন দিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের মাঝে দলীয় কোন্দল না থাকলেও দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে না পাওয়ার বেদনা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। এখানে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে দীপংকর তালুকদারের নাম ছাড়া দলের অন্য কোন ব্যক্তির নাম শোনা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগে দীপংকর তালুকদার ছাড়া অন্যান্য নেতা-কর্মীরা দলের ছোট কর্মীদের বাদ দিয়ে নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে অনেক বেশি। তবুও সকল দুঃখ বেদনা ভুলে গিয়ে আওয়ামীলীগের তৃণমূলের নেতা কর্মীরা চায় দাদা কে যেকোন মূল্যে বিজয় করতে।
তবে তিনি সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস সমর্থীত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদারের কাছে পরাজিত হন।
আসন্ন নির্বাচনে রাঙামাটি আসনের আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে অতীতের মত একক প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের ভাবনা:
রাঙামাটি সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, দীপংকর তালুকদার রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালীর মধ্যে সেতু বন্ধন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার বিকল্প কোন কেউ হতে পারে না। তিনি হচ্ছেন আমাদের অভিভাবক। আমরা দীপংকর তালুকদারকেই একক প্রার্থী হিসেবে চাই। তাকে ছাড়া অন্য আর কেউ কাউকে ভাবতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, আমরা পার্বত্য জেলা রাঙামাটি উন্নয়নে এতসব কাজ করেছি, মাঠে মাঠে এত দৌঁড়ালাম, মানুষ ঘরে ঘরে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছিয়ে দিলাম। আশা করি এরা আমাদের এ কাজের কথা মনে রেখে নির্বাচনে আমাদের দলকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে।
আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, জেলা আওয়ামীলীগ থেকে ১৯৯১ সাল হতে একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে আসছে। একাদশ নির্বাচনেও জননেতা দীপংকর তালুকদার ২৯৯নং আসন থেকে মনোনয়ন পাবে। তিনি আরো বলেন, আগামী নির্বাচনে যে কোন কিছুর বিনিময়ে জননেতা দীপংকর তালুকদারকে জয়ের মালা পড়াবো আমরা। এখানে আমরা জেলা আওয়ামীলীগের প্রাণ প্রিয় নেতা দীপংকর তালুকদারের নেতৃত্বে সু-সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ। আমরা আশাবাদী এ আসনে আওয়ামীলীগ জয়যুক্ত হবে।
রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল জব্বার সুজন বলেন, দীপংকর তালুকদারের কোন বিকল্প নেই। তিনি নেতাকর্মীদের সাথে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে থাকেন। আমরা দাদাকে ছাড়া অন্য কোন প্রার্থী দেখতে চাই না।
আসন্ন আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে সিএইটি টুডে ডট কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দীপংকর তালুকদার বলেন, রাঙামাটির আওয়ামীলীগ যাকে চায় তাকেই মনোনয়ন দেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ। তবে আমি শত ভাগ আশাবাদী এ আসন থেকে আমাকে মনোনয়ন দেবেন।
আগামীতে নির্বাচনে আবারো আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটিতে পর্যটন শিল্পের উপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হবে। এখানে উন্নয়ন করতে গেলে আঞ্চলিক দলগুলো বাঁধা হয়ে দাড়ায়, যার জন্য উন্নয়ন বার বার বাঁধাগ্রস্ত হয়।
গত নির্বাচনে ৫৩টি ভোট কেন্দ্রে জেএসএস ভোট ডাকাতি করেছে। এবার সে সুযোগ দেওয়া হবে না। ক্ষমতায় যেতে হলে জনগণের ভালবাসা নিয়ে যেতে হবে। আর কোন অবৈধ পন্থাতে যেতে দেওয়া হবে না।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের আগে আবারো সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারকে নতুন করে অবগত করা হবে। বর্তমান সরকারের আমলেও পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ যদি উন্নয়নের চিন্তা করে তা হলে আবারো আওয়ামীলীগকে ভোট দেবে।
রাঙামাটি আসনে অতীতের নির্বাচন যেমন ছিল:
আয়তনের দিক থেকে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জেলা। এ জেলার আয়তন ৬১১৬.১৩ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যার দিক থেকে এই জেলায় বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ৭ লক্ষের অধিক। সমতলের তুলনায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা ৫টি নির্বাচনী এলাকার চেয়েও বড়। কেবলমাত্র জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে এ জেলাকে একটি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা হিসেবে পরিচালনা করে আসছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন।
২৯৯ পার্বত্য রাঙামাটি আসনে ১৯৯১, ’৯৬ ও ২০০৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। প্রতিবারই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ছিল আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার। সে কারণে পাহাড়ী-বাঙালীর সকল ভোটাররা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল।
১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই অঙ্গীকার ছিল। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এর প্রাধান্য থাকবে বলে অনেকেই ধারণা করছে।