পাহাড়ে জুমের ফসল তুলতে ব্যস্ত জুমিয়ারা

প্রকাশঃ ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১২:০৬:০৯ | আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০৬:৫০:২৯
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পাহাড়ে জুম চাষের ফসল তুলতে ব্যস্ত এখন জুমিয়ারা। সারা বছর রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়ে বিভিন্ন ফসল ফলায় পাহাড়ী জনগোষ্ঠী এখন তারা সে সব উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত। কৃষি বিভাগের দাবি  তুলনামুলকভাবে গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ভালো হয়েছে। তবে অনেক জুমিয়ার দাবি তাদের ফলন ভালো হয়নি, কৃষি বিভাগ থেকে তারা কোন সহায়তা পায়নি।

‘হিল্লো মিলেবো জুমত যায় দে, জুমত যায় দে, যাদে যাদে পধত্তুন পিছ্যা ফিরি রিনি চায়, শস্য ফুলুন দেঘিনে বুক্কো তার জুড়ায়.....।’ যার বাংলা অর্থ হচ্ছে সুন্দরী মেয়েটি জুম ক্ষেতে যায়, যেতে যেতে আবার পিছন ফিরে চায়, বিস্তীর্ণ পাহাড়ে শষ্য ফসল দেখে তার বুক জড়িয়ে যায়, এটি চাকমা আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রিয় একটি গান। সারা বছর পরিশ্রম শেষে পাহাড়ি তরুণীরা যখন জুমক্ষেতের পাকা ফসল ঘরে তুলতে যায় তখন মনের আনন্দে জুম ঘরের মাচায় বসে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা গানটি গেয়ে থাকে। অধিকাংশ পাহাড়ীই জুম চাষ করে তাদের জীবন জীবিকা  নির্বাহ করে থাকেন।  জুমচাষীরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে আগুন দিয়ে জঙ্গল পরিস্কার করে শুকানোর পর ফাল্গুণ-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে জুম ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এরপর বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে পোড়া জুমের মাটিতে শুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধান, তুলা, তিল,  ভূট্টা, ফুটি, মরিচ,তিল ঢেড়স ইত্যাদি বীজ বপন করে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেই জুমের ফসল পাওয়া শুরু হয়। সে সময় মারফা, কাঁচা মরিচ, চিনার, ভূট্টো পাওয়া যায়। বর্তমানে পাহাড়ে জুমিয়া চাষীরা জুমের ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত।

রাঙামাটিতে এবার কৃষি বিভাগের মতে  জুম চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯শ ৩০ হেক্টর জমিতে। গত বছর জুম চাষে  ফলন পাওয়া গিয়েছিল ৫ হাজার ৪০ হেক্টর জমিতে। এবার সদরে ২শ হেক্টর, নানিয়াচর ৩৮০ হেক্টর, কাউখালীতে ৪৫ হেক্টর, বরকলে ৪৭০ হেক্টর, জুরাচড়িতে ৬৯০ হেক্টর, লংগদু ৫৭৫ হেক্টর, বাঘাইছড়িতে ৯শ হেক্টর, কাপ্তাই ৪৩৫ হেক্টর, রাজস্থলীতে ৫৫০ হেক্টর এবং বিলাইছড়িতে ১৬৮৫ হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে।

জুম চাষ নিয়ে জুমিয়া কৃষকদের রয়েছে ভিন্নমত, কেউ বলছে ফলন ভালো হয়েছে কেউ বলছে হয়নি, কৃষি বিভাগ থেকে তারা কোন সহায়তা পায়নি।
রাঙামাটির কাপ্তাই সড়কে মোরঘোনা এলাকার বিপুল চাকমা বলেন, গত বছর পাহাড় ধসের ফলে জুম চাষের জায়গা কমে গেছে। তারপরও যেটুকু জায়গাতে আমার চাষ করেছি, তাতে ফলন গত বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে।
তার অভিযোগ, জুম চাষের সমস্যা হলেও কৃষি কর্মকর্তারা কোনও খবর নেয়নি। জলে ভাষা জমিতে চাষ করলে তখন তাদের দেখা যায়। জুমে যে পরিমাণ ধান পাওয়া যায় তাতে কয়েক মাস চলে। কৃষি বিভাগ যদি এমন কোনও জাতের ধান আমাদের দিতো যা চাষ করলে ফলন ২-৩ গুণ বেশি হবে, তাহলে জুমের ধান দিয়ে আমরা সারা বছর চলতে পারতাম।

রাঙামাটি সদর ইউনিয়নের বড়গাং এলাকার জুমচাষি পপি  চাকমা বলেন, গত বছর জুমে ২০ কেজি ধান রোপণ করে ৪/৫ বস্তা ধান হয়েছিল। এবার ১৫/২০ বস্তা হতে পারে। গত বছরের তুলনায় এবারে জুমে ফলন ভালো হয়েছে।

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক পবন কুমার চাকমা জানান, আগের তুলনায় এবার ফলন ভালো হয়েছে, কৃষি বিভাগ জুমিয়াদের সার ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে।



ফলন কম হওয়ার ব্যাপারে এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, কৃষকদের বিভিন্ন ফসলাদি লাগানোর কথা থাকলেও যারা স্থায়ীভাবে ধানের পর পরই হলুদ লাগায় এবং স্থায়ীভাবে ফসল করতে চায় তারা একটু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জুমের ফসল জুমের নিয়মে করতে হয়। তিনি আরো জানান, এবার ধানে  কোন কোন এলাকায় গান্ধী পোকা আক্রমণের খবর আমরা পেয়েছি, সেক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছি।

এদিকে জুম চাষ পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরুপ বলা হলেও  কৃষি বিভাগের কর্মকর্তরা বলছেন বছরে একবার পাহাড়ে আগুন দেয়ার পর তারা সারা বছর ধরে কোন না কোন ফসল ফলাচ্ছেন তাদের ১২ মাসই ফসল ফলানোর জন্য উদ্ধুর্ধ করা হচ্ছে।  জুম চাষীদের আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পরিবেশ বান্ধব জুম চাষে উৎসাহিত করার পাশপাশি তাদের প্রতি সরকারের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে  চাষীরাও উপকৃত হবে ভালো ফলনের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হবে বলে বিশেষজ্ঞন মনে করছেন।