প্রকাশঃ ১৫ জুলাই, ২০২২ ০৯:১০:২২
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০৩:৫৮:৪৭
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ২০১৮ সনে নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিফের নেতা তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা হত্যাকান্ডের ঘটনায় একের পর এক হামলা-মামলায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়া ইউপিডিএফ জেএসএসের মধ্যে সমঝোতা হয়। এছাড়া ভ্রাত্বঘাতি সংঘাত বন্ধে চাকমা সার্কেল চীফসহ বিশিষ্টরা আহবান জানিয়ে ছিলেন। তার প্রেক্ষিতে দুটি সংগঠনের মধ্যে সমঝোতা হয়, কিন্তু তাদের বন্ধুত্বে যে চিড় ধরেছে তা আবারও প্রকাশ্য হয়েছে হঠাৎ ইউপিডিএফের এক কর্মী খুনের ঘটনায়। একইসঙ্গে সেই 'সমঝোতা'র শর্তের কথা উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রেরিতে বিবৃতিতে জেএসএসকে খুনোখুনি বন্ধ ও সমঝোতার শর্ত মেনে চলার আহবান জানিয়েছি পাহাড়ের পূর্ণ সায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সংগঠন প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ। পাহাড়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও পুরনো এই দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের বিবাদমান কার্যক্রমে পুরনো সখ্যতার সমঝোতা ভেঙে যে নতুন রাজনীতির মেরুকরণ হয়েছে তার আঁচ লেগেছে জনমনে।
স্থানীয় ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১২ জুলাই) সকাল ৯টার দিকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ায় এক অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় জীবন ত্রিপুরা নামে এক ইউপিডিএফ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সংগঠনটির খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক ও কেন্দ্রীয় মুখপাত্র অংগ্য মারমা অবিলম্বে খুনের রাজনীতি বন্ধের জন্য সন্তু লারমার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ঘটনার বর্ণনা জানিয়ে ইউপিডিএফ মুখপাত্র অংগ্য মারমা বিবৃতিতে বলেছেন, ১২ জুলাই সকাল ৯টার দিকে ইউপিডিএফের দীঘিনালা ইউনিটের সংগঠক জীবন ত্রিপুরা সাংগঠনিক কাজে বাবুছড়া যাচ্ছিলেন। এ সময় ধনপাদা নামক এলাকায় ওঁৎ পেতে থাকা জেএসএসের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে তিনি ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। সন্তু গ্রুপের (জেএসএস) সশস্ত্র সদস্য ডা: জ্ঞান, পাভেল, বরুণ ও রমেশের নেতৃত্বে উক্ত সশস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে।
অংগ্য মারমা বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, নিহত জীবন ত্রিপুরার (২২) বাড়ি রাজস্থলীর বটতলি গ্রামে এবং তিনি দীঘিনালায় একজন সাধারণ সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইউপিডিএফ নেতা অংগ্য মারমা সন্তু লারমা ও জেএসএসকে অবিলম্বে ভ্রাতৃ-হত্যার রাজনীতি বন্ধ করে ২০১৮ সালে দুই পার্টির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতার শর্ত মেনে চলার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোন ধরনের মুখ খুলেনি জেএসএস।
যেভাবে ইউপিডিএফ-জেএসএসের বন্ধুত্ব-ভাঙনঃ
২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ির এক কমিউনিটি সেন্টারে ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত খীসাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে ও ইউপিডিএফ আর্দশ্যচ্যুত হয়েছে- এমন দাবি তুলে তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার নেতৃত্বে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (গণতান্ত্রিক)। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ ভেঙে যায়। শুরু থেকেই ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)কে 'মুখোশ বাহিনী' হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও গণমাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করে আসছিল প্রসীতের ইউপিডিএফ।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। এর পরের বছর ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রীকে অপহরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে দেশে-বিদেশে জানান দেয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। সে সময় অপহরণের ৩২ দিন পর ছাড়া পাওয়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী মন্টি চাকমা বর্তমানে রাজনীতি নিষ্ক্রিয় থাকলেও দয়া সোনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সঙ্গেই জড়িত আছেন।
২০১৮ সালে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠার পর ২০০৭ সালে সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে গড়ে উঠা জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সঙ্গে একজোটে কাজ শুরু করে সংগঠনটি। তখন মূলত পাহাড়ের বিবাদমান চারটি রাজনৈতিক দল তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এরই প্রেক্ষিতে সন্তু লারমার জেএসএস ও প্রসীত খীসার ইউপিডিএফের মধ্যকার 'শত্রুর শত্রু-বন্ধু' এমন স্টাইলে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়। সেই সমঝোতার অন্যতম শর্ত ছিল বিবাদমান রাজনৈতিক দল দুইটির মধ্যকার অস্ত্র বিরতি, এক এলাকায় অন্য পার্টির লোকজনের আসা-যাওয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে নিজেদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড যে যার মতন পালন করে থাকবে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটির কুতুকছড়িকে ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রকাশ্যে ইউপিডিএফ নেতারাসহ নির্বাচনি প্রচারণা করেছেন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সমর্থিত প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। মূলত হঠাৎ ইউপিডিএফ সদস্য হত্যার ঘটনার ইউপিডিএফ মুখপাত্র এই সমঝোতা রক্ষার কথাই তুলেছেন।
কিন্তু ২০১৮ সালে ইইউপিডিএফ-জেএসএসের এই সমঝোতা দীর্ঘ হয়নি। চার বছরের মাথায় ২০২১ সাল থেকেই এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবারও বৈরিতা হয়েছে ইউপিডিএফ-জেএসএসের। ১২ জুলাই ফের প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউপিডিএফ নেতা খুনের ঘটনায় ইউপিডিএফ-জেএসএসের বৈরিতা প্রকাশ্যে ডানা মেলেছে। এখন কোন পথে হাঁটছে পাহাড়ের রাজনীতির মেরুকরণ সেই জিজ্ঞাসা পার্বত্য জনপদের মানুষের মাঝে।
এদিকে, নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক পাহাড়ের কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানান, ২০১৮ সালে মূলত ইউপিডিএফ ভাঙন ও রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে যাওয়ার কারণে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে গড়ে ওঠা জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)কে মোকাবিলা করতে সন্তু লারমার জেএসএসের সঙ্গে সমঝোতা কিংবা অস্ত্র বিরতি করে। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব ঠেকেনি বেশিদিন। চার বছরের মাথায় আবারও ভাঙন ধরেছে। এখন পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দুই-দুই কিংবা এক-তিন পর্যায়েও এগুতে পারে৷ সব মিলিয়ে পাহাড়ের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ হতে চলেছে।
এদিকে, এসব প্রসঙ্গে জানতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র অংগ্য মারমার মুঠোফোন নাম্বারে চেষ্টা করে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোনো নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মূলত পাহাড়ের বিবাদমান এই দল দুইটি নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। আর নেতারা আত্মগোপনে থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বশীল কারোই বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।