প্রকাশঃ ২৪ মে, ২০২২ ০৫:০৮:১৩
| আপডেটঃ ২১ নভেম্বর, ২০২৪ ০৭:০২:০৪
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্পের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধার আওতায় এসেছেন রাঙামাটির সাপছড়ি ইউনিয়নের কৃষকরা। এই সুবিধার আওতায় এসে কৃষকরা এক ফসলি জমিকে বহুফসলি জমিতে রূপান্তরের কথা ভাবছেন। সৌরবিদ্যুৎচালিত পাম্পের সেচ সুবিধায় বোরো আবাদ করে বাড়তি ফসল উৎপাদন করতে পেরে খুশি কৃষকরা। শুরুতে পাইলট প্রকল্প হিসবে যেসব কৃষক ধান আবাদে অনাগ্রহী ছিলেন, তারাও এবার বোরো ধান আবাদের কথা ভাবছেন। এদিকে সেচ সুবিধা পেলেও ধানক্ষেতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সমাধানের জন্য পাঁকা সেচ ড্রেন তৈরির দাবি কৃষকদের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নের বোধিপুর গ্রামের প্রায় ১৭ একর কৃষি জমি বর্ষা মৌসুমে আউশ আবাদব্যতিত সারাবছর পরিত্যক্ত জমি হিসেবে পড়ে থাকত। ২০২১-২২ অর্থবছরে বোধিপুর গ্রামের কৃষকদের সুবির্ধাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচ ব্যবস্থাকরণের মাধ্যমে বোরো আবাদের জন্য একটি সৌরবিদ্যুৎচালিত পানির পাম্প বসানোর বসানোর উদ্যোগ নেয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীল প্রকল্প (সিসিআরপি)। ৫ লাখ ব্যয়ের প্রকল্পটির পাইলট কার্যক্রমে অংশগ্রহণ হিসাবে এলাকার ১০-১২টি কৃষক পরিবার পরিত্যক্ত জমিতে বোরো ধান আবাদ করেন। প্রকল্পটির অধীনে স্থানীয় ৩০টি কৃষক পরিবার সেচ সুবিধার আওতায় আসবেন বলছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তবে বোরো আবাদ আলোর মুখ দেখবে কিনা সে আশঙ্কা থেকে বেশিরভাগ কৃষক বোরো ধান চাষে আগ্রহী হননি। কিন্তু মৌসুম শেষে কানিপ্রতি ২০ মণ হারে ধান উৎপাদন হয়েছে বোরো আবাদি এসব জমিতে। কৃষকদের সফলতা দেখে আগামী মৌসুম থেকে অন্যান্য কৃষকরাও তাদের জমিতে বোরো আবাদের আগ্রহী হয়েছেন।
উপকারভোগী কৃষকরা জানান, ৬০-৭০ বছর পূর্বে উঁচু-ঢালু পাহাড় কেটে সমান করে জমিগুলো তৈরি করা হলেও পানি সংকট বা সেচ ব্যবস্থাপনার অভাবে বর্ষা মৌসুমে আউশ ধান আবাদ ছাড়া অন্যান্য কোনো চাষাবাদ করা হত না। এক ফসলি জমি হিসেবে বছরে একবার এই জমিগুলোতে আউশ ধান আবাদ হতো। তবে বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পানির মাধ্যমে সেচ সংকট লাঘব হওয়ায় সেচের পানিতে বোরো আবাদ করেছেন কৃষকরা। বোরো মৌসমে কৃষকরা উচ্চফলনশীল (উফসী) ও হাইব্রিড (সংকরজাত) ধানের বীজ রোপণ করেন। এবার বোরো আবাদের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল আবাদের কথা ভাবছেন পাহাড়ি এলাকার এ কৃষকেরা। তবে সেচ ড্রেন ব্যবস্থার অভাবে তারা সেচ ব্যবস্থায় অসংগতির কথা বলছেন। ধানক্ষেতের আইলের মাঝদিয়ে ড্রেন তৈরি করা গেলে এ সমস্যা সমাধান হবে বলে জানায় কৃষকরা।
১১০ নং শুকরছড়ি মৌজার অধীন বোধিপুরগ্রামের কারবারি (গ্রামপ্রধান) বিজয় কুমার চাকমা (৬৮) বলেন, পুরো এলাকাতে ১৭ একর কৃষি জমি রয়েছে। সেচের পানির অভাবে এগুলো এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। আমরা দেখেছি, আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে এসব জমিতে বছরে একবার আউশ ধান চাষ হচ্ছে। সেচের পানির অভাবে আমরাও বছরে একবার আউশ ধান লাগাই। এবার সোলার পাম্পের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার সুযোগ করা হলেও সবাই বোরো আবাদে আগ্রহ হননি। তবে শেষ সময়ে এসে অনেকেই অন্যান্য স্থান থেকে বীজতলা কিনে এনে জমিতে বোরো ধান রোপন করেছেন। এখন দেখা গেছে একেকজন কৃষক কানিপ্রতি ২০ মণ করে ধান পেয়েছেন। তাই আগামী বছর থেকে সবাই চাষাবাদের আওতায় আসলে ৩০ পরিবার এর সুফল পাবেন।
বোধিপুর গ্রামের কৃষক শুক্র কুমার চাকমা (৬৩) বলেন, আমি তিনকানি জমিতে এবার প্রথমবারের মতো বোরো ধান আবাদ করেছি। পুরো জমিতে প্রায় ৫৫-৬০ মণ ধান পেয়েছি। বর্ষা মৌসুমে আউশ ধান আবাদ করেও এমন ধান পেয়েছি। এক ফসলি জমিতে এখন থেকে বোরোসহ অন্যান্য সফল আবাদ করতে পারব। এতে করে আমরা অর্থনৈতিকভাবে আরো সাবলম্বী হব। একই এলাকার কৃষক হেমন্ত কুমার চাকমা (৪২) বলেন, এবছর আমরা অনেকটা তাড়াহুড়ো করে জমিতে ধান লাগিয়েছি। ফলন হবে কী হবে না; এই দ্বিধা থেকে অনেকেই চাষ করেননি। এখন মৌসুম শেষে ভালো ফলন পেয়ে আমরা কৃষকরা সবাই খুশি। আমাদের লাভবান হতে দেখে অন্যান্য কৃষকরাও আগামী মৌসুমে বোরো ধান লাগানোর বলে জানিয়েছে। এদিকে, হেমন্ত, শুক্র ও বিজয় চাকমাদের বোরো আবাদের সাফল্য দেখে স্থানীয় কৃষক নীলচন্দ্র চাকমা, কলিঙ্গ চাকমা, নীরু চাকমারা আগামী মৌসুম থেকে বোরো আবাদের জন্য আগ্রহী হয়েছেন। তবে সেচ পানির সুষম বন্টনের জন্য ড্রেন ব্যবস্থা তৈরির দাবি জানায় সকলে।
এদিকে প্রকল্প থেকে সহায়তা করা সৌরবিদ্যুৎ ও পানির পাম্পটি রক্ষণাবেক্ষণ-পরিচালনার জন্য নিজেরা ফান্ড তৈরি করছেন কৃষকরা। গ্রামপ্রধান বিজয় কুমার চাকমা জানান, সোলার ও সেচ পাম্পটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতিমাসে পরিবারপ্রতি ২০ টাকা হারে ৩০টি পরিবার থেকে অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে। আবার বোরো মৌসুমে ধান ঘরে তোলার পর প্রতি কৃষক পরিবার কানিপ্রতি ২০০ টাকা করে বাৎসরিক অর্থ জমা দেবেন। এই অর্থ প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত করা হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পের (সিসিআরপি) রাঙামাটি জেলার কারিগরি কর্মকর্তা সুশীল চাকমা বলেন, ড্যানিডার অর্থায়ন ও পার্বত্য জেলা পরিষদের বাস্তবায়নে সিসিআরপি প্রকল্পের অধীন বোধিপুর এলাকার এক ফসলি জমিকে বহুফসলি জমিতে রূপান্তরিত ও স্থানীয় কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার লক্ষ্যে সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প প্রকল্পটি গ্রহন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা কৃষি জমিতে সেচ সুবিধার আওতায় এসেছেন। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথম বছর সকল কৃষক বোরো আবাদ না করলেও আগামীবছর থেকে সকলে বোরো আবাদ করবেন বলে আমাদের আশ^স্ত করেছেন। এতে করে তারা আরো সাবলম্বী হবেন বলে আমরা মনে করি। সুশীল চাকমা আরো জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৪ হাজার ২০০ ওয়াটের সোলার প্যানেল, পানির পাম্প, রিজার্ভার ও পাইপ লাইনসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়াদিসহ ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে স্থানীয় চাষীরা সেচ সুবিধার জন্য পাঁকা ড্রেন তৈরি করার দাবি জানাচ্ছেন। আমরা ড্রেন ব্যবস্থাপনার জন্য আরেকটি উপ-প্রকল্প গ্রহণের চেষ্টা করছি। এটি পাশ হলে কৃষকের ড্রেনেজ সংকট কেটে যাবে।