শুক্রবার | ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

রাঙামাটি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া স্বাক্ষরে টাকা তোলাসহ নানা অভিযোগ

প্রকাশঃ ২৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০৯:৪৯:৩০ | আপডেটঃ ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ ১১:৫৮:১২
হিমেল চাকমা, বিশেষ প্রতিবেদক, রাঙামাটি। ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে শিক্ষকদের সম্মানী তুলেন। সততা স্টোরের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে না দিয়ে নিজের কাছে রাখেন। শিক্ষক প্রশিক্ষণে নলকুপের পানি দিয়ে বোতলজাত পানির বিল করেন। রেস্টুরেন্ট থেকে খালি ভাউচার নিয়ে ফল মুল ক্রয়ের বিল করেন। প্রশিক্ষনার্থীদের নাস্তা দেন ৩০ টাকার। বিল করেন ১০০ টাকার। ফোল্ডার দেন ৬৮ টাকায়। বিল করেন ১৬০ টাকা।

এনটিআরসিএ নিয়োগকৃত শিক্ষকদের  এমপিও ফাইল বিভাগে না পাঠিয়ে ফেরত দেন। ঘুষ পেলে তা প্রেরণ করেন। ঘুষ চান বেশী। পছন্দ না হলে সবকিছুতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। বিদ্যালয়েও নিয়োগে ঘুষ নেন। এমন সব অভিযোগই রাঙামাটি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম খীসার বিরুদ্ধে।

অভিযোগগুলো অনুসন্ধান করে সত্যতা পাওয়া গেলেও সবগুলোই অস্বীকার করেছেন উত্তম খীসা।  অনুসন্ধানে পাওয়া কাগজপত্র, অডিও, ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছর ২৬ জুন  স্মারক নং ৩৭.০২.৮৪০০.১১৫.১৯-১৯৫ মুলে জেলার ৯০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সততা স্টার চালুর জন্য ১৩ লাখ  ৫০ হাজার টাকা বরাদ্ধ দেয় রাঙামাটি জেলা পরিষদ। যা থেকে প্রত্যেকটি বিদ্যালয় পাবে ১৫ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯ টি বিদ্যালয়কে এখনো  টাকা দেওয়া হয়নি। এসব বিদ্যালয়ের নাম পরিষদের তালিকায় আছে। তালিকায় থাকা কাপ্তাই নৌ বাহিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাকে টাকা দেওয়া হয়নি। কাউখালীর ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান বলেন, তালিকায় আমার স্কুলের নাম আছে। কিন্তু টাকাগুলো দেওয়া হয়নি।

রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অটন চাকমা বলেন,  সহকর্মীদের খবরে খোঁজ নিয়েছি। স্কুলের নাম তাদের তালিকায় নেই বলা হয়েছে।

কাপ্তাই নারানগিরি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম মুনসুরি বলেন, জেলা পরিষদের ল্যাপটপ ও সততা স্টোরের টাকা বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এগুলো গ্রহণের আগে ডিইও স্যার আমার কাছ থেকে ল্যাপটপ ও সততা স্টোরের টাকা পাওয়ার প্রত্যয়নে স্বাক্ষর নেন। কিন্তু  সেদিন শুধু ল্যাপটপ দেওয়া হয়। টাকাগুলো চাইলে বলা হয় তালিকায় আমার বিদ্যালয়ের নামটি নেই। তাই আসার সময় প্রত্যয়নে করা একটি স্বাক্ষর মুছে এসেছি।

এ ব্যাপারে, জেলা শিক্ষা অফিসে হিসাব বিভাগে খবর নিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এ কাজটি ডিইও নিজ হাতে করেছেন। তিনি এক বাক্যে স্বীকার করেন ব্যপক অনিয়ম দুর্নীতি হচ্ছে শিক্ষা অফিসে। আমার কিছুই করার নেই।

রাঙামাটি জেলা পরিষদের হিসাব কর্মকর্তা খোরশেদ আলম চেীধুরী বলেন,আমরা সব টাকা জেলা শিক্ষা অফিসকে দিয়ে দিয়েছি তারা বিতরণ করবে। এতদিন বিতরণ হয়ে যাবার কথা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা বরকলের দুর্গম এলাকার ১০টির মধ্যে ২টি বিদ্যালয় বাদে ৮টি বিদ্যালয়কে টাকাগুলো দেওয়া হয়।

চলতি বছর  জেলা পর্যায়ে সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগীতায় রাঙামাটি শহরের রানী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে একদিনে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন ১৬ জন বিচারক। এদের প্রতিজনের সম্মানী  ছিল ১ হাজার টাকা। ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে ৯শ টাকা করে উত্তোলন করেন ১৪ হাজার টাকা। বিচারক ১৬ জনই বলেন তারা কেউ সম্মানী পাননি।

রাঙামাটি সরকারী কলেজের সহকারী অধ্যাপক অনির্বান বড়–য়া বলেন, বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি কিন্তু সম্মানী দেওয়া হয়নি। একই কলেজের প্রভাষক এমারসন চাকমা বলেন, সম্মানী দেয়া হয়নি ভাল কথা কিন্তু আমাদের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে এটি খারাপ লাগছে। রাঙামাটি পাবলিক কলেজের মহসীনা ফেরদৌস বলেন, স্বাক্ষরও দেননি সম্মানীও দেওয়া হয়নি। রানী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সজল বড়–য়া, শহীদ আব্দুল আলী একাডেমীর সহকারী শিক্ষক উজ্জল চেীধুরী, ও সম্মানী না পাওয়ার কথা বলেন। সে প্রতিযোগীতায় সর্বমোট বরাদ্ধ ছিল ৫০ হাজার টাকা। ১৮ জুন অনুষ্ঠান পরিচালনা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের ব্যয় বিবরণীতে স্বাক্ষর করেন উত্তম খীসা।

অভিযোগ অস্বীকার করে উত্তম খীসা বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। আমি ওদের নিজের পকেট থেকে ৭শ টাকা করে দিয়েছি। সমস্যা হল প্রতিযোগীতার অনেক পরে টাকাগুলো এসেছে। তবে টাকা দিয়েছি।

অনুসন্ধানে জানা যায়  ২০১৭ সালে ১০ ডিসেম্বর ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯০ শিক্ষক নিয়ে টিসিজি (টিচারর্স কারিকুলাম গাইড) ট্রেনিং আয়োজন করা হয়। যার সরকারী বরাদ্ধ ছিল ৩১,১৯,৭৬০ টাকা।

২০১৮ সালে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত  ১৭৬ জন শিক্ষক নিয়ে পিবিএম ( পারফর্মস ব্যাচড্ ম্যানেজম্যান্ট) ট্রেনিং আয়োজন করা হয়। যার সরকারী বরাদ্দ ছিল ২৩,৪৩,৫৮০ টাকা।


২০১৯  সালে ২৮ এপ্রিল থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ৭টি ব্যাচে ১২৩০ জন শিক্ষক নিয়ে এলএসবিই (লাইফ স্কিল ব্যাচড্ ইডুকেশন) ট্রেনিং আয়োজন করা হয়। যার সরকারী বরাদ্ধ ছিল ৭০,০২,০০০ টাকা।  সবগুলোরই ট্রেনিং ভ্যানু ছিল রানী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়।


এ প্রশিক্ষনে অংশ নেওয়া একাধিক শিক্ষক বলেন, প্রশিক্ষণ চলাকালীন তাদের কাউকে বোতলজাত করণ পানি দেওয়া হয়নি। রানী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের নিজস্ব গভীর নলকুপ থেকে প্রশিক্ষনার্থীদের খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অফিসের ব্যয় বিবরণী ভাউচারে  বোতলজাত পানি বাবদ খরচ দেখানো হয়।

এসব প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষনার্থীদের নাস্তা দেওয়া হয় ৩০ টাকার। বিল করা হয়েছে ১০০ টাকার। ফোল্ডার দেওয়া হয়েছে ৬৮ টাকায়। বিল করা হয়েছে ১৬০ টাকায়।

জেলা শিক্ষা অফিসের সামনের ফ্লেভার রেস্টুরেন্ট। এ রেস্টুরেন্ট বিয়ে অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পোলাও,বিরানী বিক্রি ও সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ রেস্টুন্টের ভাউচার দিয়ে সিঙ্গারা, সমুচা, কেক, আপেল, মিনারেল ওয়াটার, কলা ক্রয়ের ভাউচার তৈরি করা হয়।

¬¬
জেলা শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্ট  এক কর্মকর্তা বলেন, অনিয়ম হচ্ছে ঠিক আছে। যেখানে টাকা সেখানেই ভাগ বসায় ডিইও। টাকা ছাড়া কোন কাজ হয় না। একের পর এক ভুয়া ভাউচার তৈরি করতে হয় আমাদের। ভাউচারগুলো বিভিন্ন দোকানের। কিন্তু দেখেন, হাতের লেখা সব এক। তিনি বলেন, আমাদের কোন দোষ নেই। যেসব অনিয়ম হচ্ছে সবই শিক্ষা অফিসার করছেন। তিনি বলেন, আমরা বাধ্য হচ্ছি।

কোন প্রশিক্ষণে চিকেন রোল দেয় হয়নি। কিন্তু ভাউচারে প্রতিটি চিকেন রোল ৩শ টাকার ক্রয় দেখানো হয়। রানী দয়াময়ী স্কুলে গভীর নলকুপ থেকে খাবার পানি সরবরাহ করা হয়। বলে কোন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষনার্থীদেরও বোতলজাত পানি দেওয়া হয়নি। কিন্তু ভাউচারে বোতলজাত পানি ক্রয় দেখানো হয়েছে। প্রশিক্ষণের বিভিন্ন কাগজপত্র শিক্ষা অফিস থেকে ফটোকপি করা হয়। কিন্তু বাইরে দোকানের ভাউচার এনে ফটোকপির খরচ দেখানো হয় বলেন এ কর্মকতা। এ ব্যাপারে উত্তম খীসা বলেন, কোনটিতে অনিয়ম হয়নি। হয়তো ৪/৫ টাকা এদিক সেদিক হয়েছে।

উত্তম খীসার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ কতৃক নিয়োগকৃত শিক্ষকরা  উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে অনলাইনের মাধ্যমে এমপিও ফাইল জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে প্রেরণ করেন। এ এমপিও আবেদন বিভিন্ন অজুহাত বা ভুল দেখিয়ে তা বিভাগে প্রেরণ না করে বাতিল করে দেন। ঘুষ পেলে তা ফরোয়ার্ড করে দেন। না দিলে তা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বাতিল করে দেন।

রাঙামাটি সদরের মগবান বড়াদম সুরবালা স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে বিদ্যালয়ে এক শিক্ষক নিয়োগ পায়। তার এমপিও আবেদন তিনবার রিজেক্ট করে ডিইও। পরে উপায় না দেখে ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিলে তারপর ফরোয়ার্ড করে দেন। এভাবে ছয় মাস তার আবেদন ঝুলে থাকে। ঘুষের টাকা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি দিয়ে দেয় বলেন ঐ শিক্ষক।

এ ব্যাপারে উত্তম খীসা বলেন, আমার আমলে এমপিও হওয়া এমন একজন শিক্ষক এনে দেন যিনি বলবে  ডিইওকে ঘুষ দিতে হয়েছে। সুতরাং এ কথা সত্য নয়। বরং আমি চেষ্টা করেছি সবশিক্ষক যেন এমপিওভুক্ত হয়।

নানিয়াচর উপজেলার সাবেক্ষং ইউনিয়নের গাইন্দ্যাছড়ি  উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের সময় ঘুষ নেন উত্তম খীসা।

সে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শান্তিপুর্ন চাকমা বলেন, বিদ্যালয়ের জমিদাতা পরিবারের সদস্য হওয়ায়  তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তার কাছ থেকেও ঘুষ নেন ডিইও। এ টাকা আমাকে নিজ হাতে দিতে হয়েছে। না দিলে স্বাক্ষর করে না। বলেন, তাঁর এমন আচরণ দেখে আমি অবাক হয়েছি। সামান্য টাকার জন্য তিনি এত নিচে নামবে আমি ভাবিনি।

সবগুলো অভিযোগ অস্বীকার করে উত্তম খীসা বলেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ ষড়যন্ত্র করছে। তাদেরকে আামি চিনে ফেলেছি।  আমার যে সম্পদ, সেগুলো আমার চাকুরী জীবনে খুব কষ্ট করে করেছি। শিক্ষা অফিসার হওয়ার আগে শিক্ষকতার সময় টিউশন করেছি। আমার কোন অবৈধ সম্পদ নেই।

এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions